মূলধারার রাজনীতিকদের কাছে নিউইয়র্কের বাংলাদেশ কম্যুনিটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে

বাঙালী প্রতিবেদনঃ নিউইয়র্কের বাংলাদেশী—আমেরিকানরা যে মূলধারার রাজনীতিকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন ইতিমধ্যেই, তা হয়ত অনেকেই বুঝতে পেরেছেন। রিপাবলিকান গভর্নর জর্জ প্যাটাকি ১৯৯৫ সালে শপথ নেয়ার পর বাংলাদেশ কম্যুনিটির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। কয়েকবার এসেছেন কম্যুনিটি ইভেন্টে এবং ফান্ড রেইজিংএ। বাংলাদেশের ড. ইউনুসের সাথে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন এবং ফাস্টর্ লেডি হিলারি ক্লিনটনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন দ্বিতীয় আমেরিকান প্রেসিডেন্ট যিনি ঢাকা সফর করেন। এর আগে প্রেসিডেন্ট জনসন গিয়েছিলেন। হিলারি ক্লিনটন একাও গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাকের প্রজেক্ট দেখতে বাংলাদেশ যান। সে কারণে নিউইয়র্ক থেকে ইউএস সিনেটর নির্বাচনের আগে তিনি তার সংবাদ সম্মেলনে বাংলা ভাষার সংবাদ মাধ্যমগুলোর প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানান। এছাড়াও সেই নব্বই ও নতুন শতাব্দীর শুরুর দশকে নিউইয়র্ক থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস সদস্য যেমন গ্যারি একারম্যান, বেঞ্জামিন গিলম্যান, স্টিফেন সোলার্জ, জোসেফ ক্রাউলি বাংলাদেশ কম্যুনিটির সাথে সবসময় সুসম্পর্ক রেখেছেন। অথচ নিউইয়র্ক সিটির সম্প্রতিকালের মেয়র এডওয়ার্ড কচ, রুডি জুলিয়ানি, মাইকেল ব্লুমবার্গ কোনো যোগাযোগ রাখেননি। কেবল ডেভিড ডিনকিন্স নিউইয়র্কের বাংলাদেশী সাংবাদিকদের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন ১৯৯২ সালে আর মাইকেল ব্লুমবার্গ তার তৃতীয় মেয়াদে (বিশেষ) নির্বাচনের আগে ভোট চাইতে বাংলাদেশীদের দ্বারস্থ হন। তবে ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে ডেমোক্রেটিক মেয়র প্রার্থী মার্ক গ্রিন সাপ্তাহিক বাঙালীকে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। এছাড়াও স্টেট সিনেটর ও এসেম্বলি সদস্যবৃন্দ সহ সিটি কাউন্সিল সদস্যরা নিজ নিজ ডিস্ট্রিক্টে বাংলাদেশীদের কাছে ভোট চেয়েছেন নির্বাচনের আগে।
বিল ডি ব্লাজিও প্রথম কোনো মেয়র প্রার্থী এবং মেয়র হিসাবে নিউইয়র্কের বাংলাদেশী কম্যুনিটির সাথে গভীর সম্পর্ক তৈরি করেন। কারণ তিনি এর আগে ব্রুকলীনের বাংলাদেশী অধ্যুষিত চার্চ—ম্যাকডোনাল্ড এলাকা থেকে নির্বাচিত সিটি কাউন্সিলম্যান ছিলেন। ফলে খেটে খাওয়া শান্তিপ্রিয় এই কম্যুনিটিকে চিনতেন। মেয়র হওয়ার পর তিনি সিটি হল ও গ্রেসি ম্যানসনে বারবার বাংলাদেশীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কারণ ততদিনে নিউইয়র্ক সিটিতে বাংলাদেশীদের সংখ্যা বেড়ে গেছে অনেক। গ্রেস মেং কংগ্রেসে নির্বাচনের আগে বারবার ভোট চেয়েছেন বাংলাদেশীদের কাছে। এমন কি তার নির্বাচনী প্রচারণায় হিলসাইড এভেন্যুর সাইডওয়াকে বাংলাদেশের স্টাইলে শোভাযাত্রাও হয়েছে। এর মূল কৃতিত্ব জ্যামাইকা বাংলাদেশ ফ্রেন্ডস সোসাইটির। বিশেষ করে এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ফখরুল ইসলাম দেলোয়ারের উদ্যোগ উল্লেখযোগ্য। কুইন্স বরো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মেলিন্ডা কাটজ তার প্রচারণা শুরু করেছিলেন জ্যামাইকায় বাংলাদেশী কম্যুনিটি থেকে। এর কৃতিত্বও জ্যামাইকা বাংলাদেশ ফ্রেন্ডস সোসাইটির।
মেলিন্ডা কাটজ বরো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তথ্য—উপাত্ত সহ ঘোষণা করেন কুইন্সে বাংলাদেশ কম্যুনিটি হচ্ছে সবচেয়ে দ্রুত বর্ধমান এথনিক কম্যুনিটি। তার এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কম্যুনিটি ভোটপ্রার্থীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফলে গত ১২ বছরে যারা নির্বাচন করেছেন তারা বাংলাদেশ কম্যুনিটিতে এসেছেন ভোট চাইতে। এককভাবে বাংলাদেশ কম্যুনিটিতে না এলেও ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাইমারিতে ভোট চাইতে কুইন্সে এসেছিলেন সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স। তার সভায় গান গেয়েছিলেন বাংলাদেশী—আমেরিকান অনীক খান। আর স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে কাজ করেছিল নতুন প্রজন্মের বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত ছেলেমেয়ে। গত বছর সিনেট নির্বাচনে চতুর্থ মেয়াদের আগে ভোট চাইতে বারবার এসেছেন বাংলাদেশ কম্যুনিটির সিনেটর চাক শুমার। আর বাংলাদেশীদের সাথে সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ট হন বর্তমান মেয়র এরিক এডামস। এ পর্যন্ত নিউইয়র্কে যতজন নির্বাচিত রাজনীতিক বাংলাদেশীদের কাছাকাছি এসেছেন এরিক এডামস তাদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগণ্য।
তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে আসন্ন ৪ নভেম্বরের মেয়র নির্বাচনী প্রচারণা। প্রথমত দুই প্রার্থী মেয়র এরিক এডামস ও জোহরান মামদানি তাদের আকর্ষণ করার প্রকিযোগিতা শুরু করেন। এরপর মেয়র এডামস তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিলে এখন সেই জায়গায় এসেছেন সাবেক গভর্নর এ্যান্ড্রু কোমো। আর সে কারণে জোহরান মামদানি বাংলাদেশ কম্যুনিটিকে আরো বেশি টানছেন। তারা শেষের কয়েক সপ্তাহ যাচ্ছেন বিভিন্ন মসজিদে ও পূজা মন্ডপে। সেই সাথে বাংলাদেশীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও আয়োজনে। এইসব খবর এখন আর কেবল কম্যুনিটি সংবাদ মাধ্যমে নয়, মূলধারার সংবাদপত্র ও টিভিতেও প্রচারিত হচ্ছে।
এর কারণ মূলত বাংলাদেশীদের ভোট ব্যাংক বড় হওয়া এবং মূলধারার প্রতি গভীর আকর্ষণ। দুএকটি ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশীরা তাদের কাছে অত্যন্ত আন্তরিক, ভদ্র ও সমাজসচেতন হিসাবে পরিচিত। এমন কি অতিথিপরায়ণ হিসাবেও পরিচিত। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশীরা তাদের বিরিয়ানিসহ পিয়াজু, চপ, সিঙ্গারা, সামুচা খাওয়াতে ভুল করে না, জোর করে হলেও।
এইসব প্রক্রিয়া হঠাৎ করে হয়নি। আশির দশকের শেষ থেকে বাংলাদেশ আমেরিকা পলিটিক্যাল এ্যাফেয়ার্স ফ্রন্ট থেকে শুরু করে বাংলাদেশ সংসদ, এলায়ান্স অব সাউথ এশিয়ান আমেরিকান লেবার বা এ্যাসাল, আমেরিকা বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি, জ্যামাইকা বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি, নিউ আমেরিকান ডেমোক্রেটিক ক্লাব, নিউ আমেরিকান উইমেন্স ফোরাম, নিউ আমেরিকান ইয়ুথ ফোরাম, নিউ আমেরিকান ভোটার এ্যাসিস্ট্যান্স বা নাভা সহ আরো বেশ কিছু সংগঠন মূলধারার সাথে বাংলাদেশীদের সেতুবন্ধন রচনার কাজ করে গেছে বা আজো করে যাচ্ছে।
যারা সেই শুরুর দিকে এই সেতুবন্ধন রচনার কাজে জড়িত ছিলেন তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য মোহাম্মদ আমিনউল্লাহ, ডা. এম. বিল্লাহ, মোহাম্মদ সালেহ, আওলাদ হোসেন খান, মো. হোসেন খান, ড. দেলোয়ার হোসেন, ডা. আসাদ খান, ডা. ওয়ালেদ চৌধুরী, এহসান ইমদাদ, নার্গিস আহমেদ, গোলাম মেরাজ, এহসান রহমান, মোরশেদ আলম, গিয়াস আহমেদ, ডা. দিলিপ নাথ, ম্যাফ মিসবাহ উদ্দিন, ইঞ্জিনিয়ার মো. সাদেক, ফখরুল আলম, মুজিবউর রহমান, আবদুস শহীদ, মোহাম্মদ এন. মজুমদার, ফখরুল ইসলাম দেলোয়ার, ফাহাদ সোলায়মান প্রমুখ (সংগঠন ও ব্যক্তির নামের তালিকা বড়। সব নাম ও সব সংগঠনের নাম দেয়া সম্ভব হলো না বলে দুঃখিত)।
এইসব কর্মকান্ডের মধ্যেই গিয়াস আহমেদ, গোলাম মেরাজ, এহসান রহমান সহ কয়েকজন বন্ধু মিলে গড়ে তোলেন আমেরিকায় বাংলাদেশীদের প্রথম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘বাংলাদেশ কংগ্রেশনাল ককাস’।
আজ যে মূলধারার রাজনীতিকরা বাংলাদেশীদের কাছে আসছেন তার ভিত্তি তৈরি করেছেন এইসব উদ্যোগী, নিবেদিত ও সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ। কম্যুনিটি যেন তাদের অবদানের কথা স্মরণ করতে দ্বিধা না করে।