দীর্ঘতর পথে গাজার শান্তি পরিকল্পনা || ড. জীবন বিশ্বাস

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২৯ সেপ্টেম্বর হোয়াইট হাউজের স্টেট ডাইনিং রুমে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সংগে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে গাজার ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা প্রস্তাবের খসড়া পেশ করেন। ২০২৩ সালের অক্টোবর হামাসের আক্রমণে প্রায় ,২০০ ইসরাইলি নিহত এবং ২৫১ জন অপহৃত হওয়ার দুই বছর পর, মিশরের (ইজিপ্ট) শারম আলশেখ শহরে ইসরাইল হামাসের আলোচনা শুরু হয়েছে ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ২০ দফা পরিকল্পনাকে ঘিরে। ইসরাইল শর্তসাপেক্ষে এই প্রস্তাবে সম্মতির ইঙ্গিত দিলেও হামাস এখনও পূর্ণ সম্মতি দিচ্ছে না। তারা স্থায়ী যুদ্ধবিরতি পূর্ণ সৈন্য প্রত্যাহার চায় এবং নিরস্ত্রীকরণে অনিচ্ছুক। এদিকে শান্তি পরিকল্পনার প্রতিদিনের বিলম্বের মূল্য গাজায় বেড়েই চলেছে। গাজায় নিহত প্যালেস্টাইনিদের সংখ্যা ৬৭,০০০ এরও বেশি, আহত প্রায় ,৭০,০০০। অপরদিকে গাজায় ইসরাইলি বন্দি রয়েছেন প্রায় ৪৮ জন, যাঁদের মধ্যে কেবল ২০ জনের জীবিত থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে। উপরোক্ত সংখ্যাগুলোই বিশ্বের সামনে এক কঠিন প্রশ্ন তুলে ধরেছে; গাজায় ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নযোগ্য কি না, এবং সাফল্য পেলে তার রূপটি কি হতে পারে? অন্যদিকে হঠাৎ করে লাইম লাইটে আসা বাংলাদেশের ফটোগ্রাহক শহীদুল আলমের ফ্লোটিলা জাহাজে চড়ে গাজার ৭০ নটিকেল মাইলের কাছাকাছি ভেসে আসার কৌতুককর খবরে নিউইয়র্কের বাঙালি কমিউনিটিতে কৌতুহলী চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। এসব প্রসঙ্গ নিয়েই আজকের উপসম্পাদকীয়।

ট্রাম্পের শান্তি প্রস্তাবটি প্রাথমিকভাবে মোটামুটি ভালো গতি পেয়েছে। ইজিপ্টের শারম আলশেখে শান্তি প্রস্তাবটির সঠিক পরিকল্পনায় ধারাবাহিকভাবে পরোক্ষ আলোচনা চলছে। ওয়াশিংটন জ্যেষ্ঠ দূত পাঠিয়েছে। আঞ্চলিকভাবে ইরান বাদে মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমর্থন একত্রে মিলেছে। এক অভূতপূর্ব জোট, যা কূটনৈতিক আর্থিক দুদিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। এই জোটের বাস্তব তাৎপর্য উপেক্ষা করার উপায় নেই। এর ফলে যুদ্ধবিরতি টেকসই হতে পারে এবং শাসনব্যবস্থা সুচারুভাবে চলতে পারে। আর তা যদি কোনো কারণে না হয় তাহলে পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি আগের মত কেবল কাগজেই রয়ে যাবে। কিন্তু ট্রাম্পের এই পরিকল্পনার সাফল্য নির্ভর করছে পরিকল্পনার কাঠামোতে, মোটেই সমর্থকদের সংখ্যায় নয়। এই পরিকল্পনার সাফল্যের পেছনে স্বাধীন বিশ্লেষকেরা নিম্নের তিনটি নকশাগত শর্তকে নির্ণায়ক বলে দেখছেনঃ

) সময়সূচি বাস্তবায়নগ্যারান্টি স্পষ্ট করাঃ প্রস্তাবটি ধাপে ধাপে এগিয়ে নিতে হবে। প্রথমে যুদ্ধবিরতি এবং এর পরে ধারাবাহিকভাবে বন্দিমুক্তি বন্দি বিনিময়, আইডিএফ পুনর্বিন্যাস প্রত্যাহার, আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতাবাহিনী (আইএসএফ) মোতায়েন, শাসনক্ষমতা হস্তান্তর ব্যাপক পুনর্গঠন। কিন্তু ট্রাম্পের প্রস্তাবে ইসরাইলি সৈন্য প্রত্যাহার হামাসের নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে তারিখ, মানদন্ড পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া অনুপস্থিত। শেষ মুহূর্তের ইসরাইলি সংশোধনে বলা হয়েছে, ‘সমস্ত সামরিক, সন্ত্রাসী আক্রমণাত্মক অবকাঠামো ধ্বংস করা হবে এবং পুনর্নির্মাণ হবে না।অর্থাৎ নিরস্ত্রীকরণের ভাষা এমনভাবে বিস্তৃত হয়েছে যা শুধুমাত্র হামাস নয়, কার্যত সব প্যালেস্টাইনি গোষ্ঠীর নিরস্ত্রীকরণকে ইঙ্গিত করে। ধরনের ভাষা প্রয়োগই শান্তি প্রস্তাবে বিষমিশ্রণ হিসেবে কাজ করতে পারে। পারস্পরিক সমঝোতা কিন্তু সময়বদ্ধ ইসরাইলি পদক্ষেপ ছাড়া একতরফা আত্মসমর্পণের শর্ত হামাসের জন্য রাজনৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য হতে পারে, আরঝুঁকি না কমা অজুহাতে ইসরাইল কর্তৃক গাজার ১৭%—ভার জায়াগানিরাপত্তা বাফারহিসেবে দখল দীর্ঘায়িত করার সুযোগ তৈরি করতে পারে।

) বৈধতাসংবেদী, সীমিতম্যান্ডেট দ্রুতকার্যকর আইএসএফঃ চ্যাথাম হাউস ইঙ্গিত করেছে, কোনো জাতিসংঘ মিশন নয় বরং ট্রাম্পের নেতৃত্বেবোর্ড অব পিসথাকবে যেখানে টনি ব্লেয়ারের মতো ব্যক্তিত্ব থাকবেন এবং বোর্ডের অধীনেই আইএসএফ (ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যাবিলাইজেশন ফোর্স) মোতায়েন করা হবে। পৃথিবীতে এমন মডেলের পূর্বদৃষ্টান্ত নেই। বহুজাতিক বাহিনীর নিয়মাবলি, মানবাধিকার সুরক্ষা জবাবদিহি দাঁড় করাতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়। ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) যদি আইএসএফ মোতায়েন করা পর্যন্ত রয়ে যায়, তাহলে বহু প্যালেস্টাইনি আইএসএফকেঅধিকারের ধারাবাহিকতাহিসেবে দেখবেন, যা বৈধতাকে দুর্বল করবে। আবার অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদান আইএসএফ বাহিনীকে দৈনন্দিন দমনের ভূমিকায় টেনে নিতে পারে। ইসিএফআর (ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেইন রিলেশন্স)—এর সুবিবেচ্য প্রস্তাব হচ্ছে, আইএসএফএর ভূমিকা সংকীর্ণ রাখা, আঞ্চলিক অংশীদারের সহায়তায় গাজায় বেসামরিক পুলিশ প্রশিক্ষণ, এবং সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে সব ইসরাইলি সামরিক পদক্ষেপের সঙ্গে মোতায়েনের শর্ত জুড়ে দেওয়া।

) ‘এক্সপোর্টেড অ্যাডমিনিস্ট্রেশননয়, প্যালেস্টাইনি অধিকার এজেন্সি। শান্তি প্রস্তাব অনুযায়ী, হামাস দৈনন্দিন প্রশাসন থেকে সরে দাঁড়াবে এবং আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় একটি প্রযুক্তিনির্ভর স্থানীয় কমিটি গাজার সেবাশাসন পরিচালনা করবে। দ্য গার্ডিয়ানের সম্পাদকীয় বোর্ড থেকে শুরু করে ইসরাইলের সাবেক শান্তিআলোচক ড্যানিয়েল লেভি পর্যন্ত সতর্ক করেছেন, ট্রাম্পের এই শান্তি প্রস্তাব প্যালেস্টাইনিদের প্রান্তে ঠেলে দিতে পারে এবং কিছুকাল পরে ঔপনিবেশিক ছাঁচে পড়ার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে; বিশেষ করে যদি প্যালেস্টাইন অথরিটির প্রত্যাবর্তন অবাস্তব সংস্কারের শর্তে আটকে যায়। এখানে বাস্তবায়নযোগ্যতা গ্রহণযোগ্যতা অবিচ্ছেদ্য। হামাসকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টার পরিবর্তে একেবারে বাদ দিয়ে এবং প্যালেস্টাইন অথরিটিকে একমাত্র বিদ্যমান প্যালেস্টাইনি প্রাতিষ্ঠানিক ইন্টারফেস হিসেবে বাদ দিয়ে গাজায় কোনো টেকসই শাসন গড়া যাবে না। নির্বাচনের সময়পথ, জবাবদিহিমূলক পুলিশিং বিশ্বাসযোগ্য বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে একটি প্যালেস্টাইনি রাষ্ট্রই হবে স্থায়ী শান্তির পূর্বশর্ত।

প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে সাফল্য কেমন, এবং তা পেতে কী লাগবে? ন্যূনতম সাফল্য মানে হচ্ছে নিশ্চিত যুদ্ধবিরতি; কয়েক দিনের মধ্যে সব ইসরাইলি বন্দিমুক্তি, পাল্টা প্যালেস্টাইনি বন্দি মুক্তি, ধাপে ধাপে আইডিএফ প্রত্যাহার, সীমিত ম্যান্ডেটের আইএসএফ এবং এমন মানবিক সহায়তার স্রোত যা অপুষ্টিরোগের বিপর্যয় দ্রুত রোধ করে। এই জরুরি ধাপগুলোতেই বাস্তবায়নের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এমনকি সংশয়ীরাও মানছেন গত দুই বছরে যুদ্ধ থামানোর এত কাছাকাছি আর কখনও যাওয়া যায়নি।

কিন্তু মানবিক সাফল্য দ্রুত রাজনীতির স্রোতে ভেসে যেতে পারে, যদি রাজনৈতিক পথ অস্পষ্ট থাকে। স্থবির যুদ্ধবিরতিকে শান্তিতে রূপান্তর করতে তাই নিম্নের তিনটি আপগ্রেড জরুরি:

. সময় বেঁধে দেয়া, তৃতীয়পক্ষ দ্বারা যাচাইকৃত মাইলস্টোন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে ওয়াশিংটন আঞ্চলিক গ্যারান্টরদের উচিত প্রকাশ্যঅ্যাকশনম্যাট্রিক্সপ্রকাশ করা। কোন তারিখে, কোন পরিদর্শন পদ্ধতিতে, কোন কাজ সম্পন্ন হবে, আর ব্যত্যয় হলে কী শাস্তি তার ম্যাট্রিক্স প্রকাশ করা। নইলেঅসলো ট্র্যাপ’—এর মতোই অন্তহীন মধ্যবর্তী স্থবিরকাল আবারও অবৈধ নিয়ন্ত্রণকে বৈধতা দেবে, সমাধানকে নয়।

. নাগরিকমুখী সীমিত আইএসএফ। বেসামরিক কমিশনারনির্ভর স্থায়ী অফিসসহ আইএসএফ বাহিনী আকারে সংযত আঞ্চলিক নেতৃত্বাধীন হবে। এদেরপ্রবেশযেমন স্পষ্ট, ‘প্রস্থান তেমন স্পষ্ট মানদন্ডে বাঁধা থাকা চাই।

. অধিকারভিত্তিক রাজনৈতিক দিগন্ত। রাষ্ট্রগঠনের লক্ষ্যকেআকাক্সক্ষাতে নামালে আইনগত রাজনৈতিক দুই ভিত্তিই দুর্বল হয়। ইউরোপ আরব দেশগুলোর উচিত সমান্তরাল আশ্বাসপত্রে পুনর্গঠনতহবিলকে স্বাধীনতা, পৌর স্বশাসন, এক বছরের মধ্যে নির্বাচন এবং পশ্চিম তীরে ইসরাইলি বসতি বিস্তার রোধের মতো বাস্তব অগ্রগতির সঙ্গে বাঁধা যাতে প্যালেস্টাইনিরা নিজস্ব জনস্বার্থ নিজেরাই দেখভাল করতে পারে।

সম্ভাব্যতার বিচারে ট্রাম্পের পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব। কিন্তু সেখানে ক্যামেরা নিয়ে বাংলাদেশের ফটোগ্রাফার শহীদুল আলমকে যদি আত্তিকরণ করা না হয়, তাহলে ট্রাম্পের পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে! বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘস্থায়ী নিপীড়ন, সারা দেশে আইনের শাসনের অনুপস্থিতি, অপরাধের নৃশংসতায় জনসাধারণের নাভিশ্বাস, মবসন্ত্রাসের ভীতিকর বিস্তার, নারীনিগ্রহ ধর্ষণের জ্যামিতিকহারে আশংকাজনক বৃদ্ধি এবং অনিয়ন্ত্রিত দুর্নীতি সহ নানা সমস্যাকে উপেক্ষা করে ক্যামেরা কান্ধে ফ্লোটিলায় চড়ে গাজার কাছে ভেসে আসার দায়িত্বপূর্ণ (?) ঘটনাটি গাজাবাসীদের প্রতি শহীদুল আলমের চরম গাজাপ্রীতির স্বাক্ষর রেখেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদি সেদিকে একটু দৃষ্টি নিক্ষেপ না করেন, তাহলে শহীদুল আলম কিন্তু ফ্লোটিলা নয়, জটিলা জাহাজে করে নিউইয়র্কের দিকেও ভেসে আসতে পারেন। আর তা ঘটলে কিন্তু ট্রাম্পের আর রক্ষা নাই! সেক্ষেত্রে ডিপস্টেটের অর্থে কেনা ক্যামেরাসহ শহীদুল আলমকে হোয়াইট হাউজ ছেড়ে দিয়ে আমাজনের গভীর জঙ্গলে বনবাসে যাওয়া ছাড়া ট্রাম্পের আর কোন উপায়ই থাকবে না। হায়রে নির্বোধ বাংলাদেশী ক্যামেরাম্যান! আমাদের মত বাঙালিদের আপনি যে লজ্জা দিয়েছেন তা থেকে মুখ উঠিয়ে চলাফেরা করতে বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর উপায় নেই!

শহীদুলনামা থেকে আবার বাস্তবে ফিরে যাওয়া যাক। ইসরাইল হামাস, উভয় পক্ষের ওপর সমানভাবে বাধ্যতামূলক মাইলস্টোনমনিটরিং না বসালে এই ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা গাজায় গুলি থামাতে এবং বন্দিমুক্তি আনতে পারলেও তা দ্রুত অচল হয়ে যেতে পারে। সাফল্যের মানদন্ড শুধু বন্দুকনীরবতা নয়, বরং অধিকারভিত্তিক শাসনের অপরিবর্তনীয় অগ্রগতিও বটে। তবু শান্তির এই দরজা উপেক্ষা করা উচিত হবে না। যদি আমেরিকা প্যালেস্টাইনি অথরিটির সংগে একযোগে কাজ করে, আর আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলো তাদের সৈন্যঅর্থ কার্যকর গ্যারান্টির সঙ্গে শর্তায়িত করে, তবে এই শান্তির সংকীর্ণ দরজা হয়তো সত্যিই একদিন প্রশস্ত হয়ে উঠতে পারে।

 

Related Posts