তাঞ্জানিয়া, বিচিত্র দেশে বিচিত্র অভিজ্ঞতা || মনিরুল ইসলাম, সাবেক রাষ্ট্রদূত

জানুয়ারী ১৮, ২০১৮। দারুস সালাম জুলিয়াস নায়ারে এয়ারপোর্ট এলাম সকালে। প্রবাসী ব্যবসায়ী অলিউল্লাহ শফি রিসিভ করে নিয়ে এল শহরের ব্যবসাকেন্দ্র কারিয়াকো—র স্পাইস হোটেলে, ভাড়া ৪০ ডলার। ১ ডলারে স্থানীয় মুদ্রা ২,২৫০ শিলিং পাওয়া যায়। গাড়ির টায়ার—ব্যাটারির তিনটা দোকানের মালিক ফেনীর এই মধ্যবয়সী বাঙালি। শহরের প্রধান কাঁচাবাজার ‘কিছুটো’ দেখলাম ঘুরে। প্রচুর ফল সবজি মাছ মসলা শুঁটকির বড় বড় দোকান। জানুয়ারীতে পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধে গ্রীষ্মকাল, তাই এখন কাঁঠাল ও আমের প্রাচুর্য। সামিরা ভাবী খাওয়ালেন মাছ—মাংসের মজার লাঞ্চ। বাচ্চারা ইংরেজি—মাধ্যম স্কুলে বিদেশী কারিকুলামে পড়াশুনা করে, প্রবাসে এই এক সমস্যা।
ভোর ছ’টায় সমুদ্রতীরের কিবোকোনি ফিশ মার্কেট নিলামে জমজমাট। আফ্রিকার প্রত্যেকটি উপকূলীয় দেশে একই দৃশ্য। এসব দেখে মনে হয় জঙ্গলের পশুপাখি শিকার এবং সমুদ্রের মাছ ধরা দিয়ে মানবজীবনের শুরু। কোকো বীচ এলাকার ওয়েস্টার বে কূটনৈতিকপাড়ায় গেলাম, সমুদ্রতীর ঘেঁষে বৃক্ষশোভিত সুশান্ত এলাকা। গরিবদেশে বিদেশিরা থাকে আরামে আয়েশে। খেতে গেলাম ‘কেপটাউন ফিশ মার্কেট’ রেস্টুে ন্টে, রাত দশটায়ও লোকে গমগম করছে। এমন একটা রমরমা ব্যবসা থাকলে আর কি লাগে চলতে। এত দাম, তাও দেশি বিদেশি গ্রাহকে ভরা পুরো চত্বর। একটা সুপার মার্কেটে ঢু মেরেছিলাম বুঝতে, দাম যথারীতি এখানে বেশি।
বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে ছয়গুণ বড় দেশটিতে লোকসংখ্যা মাত্র ছয় কোটি। তাও দেখি ঘরবাড়িগুলি ক্ষুদ্র জীর্ণ। এত যে কষ্ট করে এত সুন্দর করে বাবুই পাখি বাসা বাঁধে, তাও সে একবার শুধু ব্যবহার করে। মুখে বলে সুইট হোম কিন্তু কতক্ষণ সে একাধারে নিজ ঘরবাড়িতে বসে থাকতে চায়? সেই আদিম স্বভাব সকল প্রাণীর: দিনে ঘুরে বেড়ানো, রাতে এক গৃহকোণে নিরাপদ আশ্রয়।
১৯/০১ আগ্রহ নিয়ে সকালে গেলাম ‘ব্র্যাক তাঞ্জানিয়া’ অফিসে। এদেশ জুড়ে ব্র্র্যাকের কর্মকান্ড বিস্তৃত। বিদেশে বাঙালির ছাপ দেখেশুনে মনটা ভরে যায় গর্বে ও গৌরবে। তারা নিয়ে গেল একটা প্রি—প্রাইমারি স্কুলে, তিন বছরের গরিব এতিম বাচ্চারা মনের আনন্দে খেলার ছলে শিখছে। আমাদের ছোটবেলায় কিচ্ছু ছিল না গ্রামের স্কুলেÑখেলাধুলা, গান, নাচ, লাঞ্চ, পোশাক, পরিকল্পনাÑকিচ্ছু না। শুধু বেত্রাঘাতের ভয়ে তটস্থ থাকত সবাই। জনাব ফজলে হাসান আবেদ নোবেল পুরস্কার পান না কেন, এই ভেবে আমি অবাক হয়ে যাই। উনার কথার চেয়ে কাজ বেশি। প্রচারণার কারণে পৃথিবী চেনে ‘গ্রামীণ’কে, ব্র্যাক—কে নয়। কেনিয়ার এক মহিলা গাছ লাগিয়ে নাকি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেল।
এদেশের এক বড়লোক ‘আজম’, উনার তৈরি বড় এক মসজিদে জুম্মা পড়লাম। অলি বললেন, সব ব্যবসাই আছে তাদের, পরকালেও তো বড়লোকের বড়আরামে থাকা দরকার। লাঞ্চ খেয়ে গেলাম জাতীয় জাদুঘর দেখতে, আফ্রিকা তথা মানবজাতির জীবন্ত ইতিহাস যেন কথা বলে উঠল আমার সাথে। পৃথিবীতে মানুষের জীবন কর্ম ও চিন্তার ক্রমবিকাশ দেখলাম। ভিলেজ মিউজিয়ামে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঘরবাড়ির প্রতিকৃতি/রেপ্লিকা বানিয়ে রেখেছে। তবে মন খারাপ হয়ে যায় দাস ব্যবসায়ী টিপ্পু টিপ—এর ছবি দেখে: দাড়ি পাগড়িওয়ালা মুসলিম হুজুর, ১৮৮০ সালে মানবপণ্যের বেচাকেনার সা¤্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। সাত লক্ষাধিক দাসদাসী বিক্রি হয় আরব/এশিয়াতে, আরো প্রায় আটলক্ষ এখানেই দাসত্ব করে। মানুষকে নিয়ে মানুষের ব্যবসা এখন কি বন্ধ হয়েছে? বুদ্ধির মারপ্যাচে প্রতারণা দেহব্যবসা শোষণ বঞ্চনা অত্যাচার সবই আছে, শুধু ধরন ও কৌশল পাল্টেছে। দেখলাম প্রায় সাত বর্গকিমি এলাকা জুড়ে দারুস সালাম ইউনিভার্সিটি, শান্ত সবুজ সুন্দর পরিবেশ দেখে মন ভরে যায় শিক্ষার্থীর। আমাদের ঘরবাড়ি যেমন ঘিঞ্জি, বিশ^বিদ্যালয়েও দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা।
বাংলাদেশ কমিউনিটি ডিনারের আয়োজন করল ইধধিৎপযর রেস্তোরাঁয়। এদেশীয় খাবারে ওমানী প্রভাব আছে, খায় ভাত উগালি চাপাতি কলা মাছ ও মাংস। প্রবীণ প্রবাসী বাবুল—সহ বাঙালিদের প্রায় সবাই এলেন সপরিবারে। ব্যস্ত প্রবাসজীবনে মাঝেমধ্যে একত্রিত হয়ে গল্প আর খাওয়াই তাদের বিনোদন। কমিউনিটিতে সবার প্রিয় আপা, ইউএনএফপিএ—এর ডেপুটি হাসিনা বেগম আসতে পারেননি বলে ফোনে দুঃখপ্রকাশ করলেন।
২০/০১ সকালেই কুষ্টিয়ার মানুষ সফিক—সোনিয়ার বাসায় গেলাম ‘কিগামবনি’ দ্বীপে, ভারত মহাসাগরের তীরে। ব্যবসা করে জমি বাড়ি সবই করেছে, তাও সফিক বলে বুড়া বয়সে দেশে ফিরে আসবে। জন্মের উৎসে মৃত্যুর ঠিকানা। কয়েকটা রিসোর্ট দেখাল সাদাবালুর সমুদ্রতীরে। শুধু এই দ্বীপে নয়, দেশজুড়েই নাকি ‘কাজুবাদাম’ গাছের ছড়াছড়ি, আম কাঁঠাল তো কথাই নাই। কৃষিপ্রধান দেশটিতে হয় ভুট্টা গম কাসাভা মিষ্টিআলু বীন কলা ধান কফি তুলা চা তামাক আখ সিসাল ইত্যাদি।
চল্লিশ ডলারে কিলিমাঞ্জেরো নামক ফেরিতে দু’ঘন্টার পথ জাঞ্জিবার চলে এলাম সন্ধ্যায়। এক কিমি হেঁটে শহরে ঢুকে হোটেল দেখলাম কয়েকটা। পঞ্চাশ ডলারে বীচফ্রন্ট হোটেল পেলাম। সহযাত্রী আলেমুল ইমরান নিয়ে গেল বিখ্যাত ‘দারাজানি’ মার্কেট। মারাক্কেশের জামে এল—ফালা ও বেইজিং—এর ফুড স্ট্রীটের অনুরূপ, তবে ক্ষুদ্রায়তন। বিভিন্ন ধরনের মাছভাজি, ফল, কাবাব খাচ্ছে লোকজন। অনলাইনে দেখলাম এখানকার ‘জাঞ্জিবার পিজা’ নাকি বিখ্যাত। কিনে দেখি জাস্ট রুটির ভেতর মাংসের কিমা, মোগলাই পরোটার মতো। কামের চেয়ে নামেই চলে দুনিয়ার এসব ‘হিড়িকলাগা’ জিনিস। সমুদ্রতীর ঘেঁষে ঐতিহাসিক সংযোগের কারণে এখানকার অনেক মানুষ ইয়েমেনী—ওমানী—আরবদের বংশধর।
পূর্ব আফ্রিকার দাস ব্যবসার কেন্দ্রস্থলে গেলাম। স্লেভ—মার্কেট ও এসংক্রান্ত জাদুঘর দেখলাম। লোমহর্ষক ইতিহাসের সামনে কোনো বিবেকবান মানুষ স্থির থাকতে পারবে না। একমানুষ অন্যমানুষের সাথে যেরকম নির্মম নির্দয় ব্যবহার করে, পৃথিবীর কোনো প্রাণী তার সমজাতীয়দের সাথে এরকম করতে পারে নাÑএজন্যই মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী? বর্তমানে এখানে গড়ে তুলেছে চার্চ। বার্ষিক সাতলক্ষ পর্যটকের জন্য শহর জুড়ে গড়ে উঠেছে স্যুভেনির দোকান, হোটেল, রেস্তোরাঁ। এদেশে এসে আরো কত পর্যটক যায় আফ্রিকার সর্বোচ্চ পর্বত কিলিমানজারো এবং পশুপাখির মহাসা¤্রাজ্য সেরেনগেতি দেখতে। (আগামী সপ্তাহে সমাপ্য)