আমেরিকার শিক্ষা ও গবেষণায় কুঠারাঘাত

অপেক্ষাকৃত নতুন দেশ আমেরিকার গৌরব শুধু শৌর্য—বীর্যে নয়, সাহিত্যেও তার অবদান অনস্বীকার্য। উনবিংশ শতকে এই যাত্রা শুরু সামরিক শক্তি হয়ে ওঠার অনেক আগে। সেই ওয়াল্ট হুইটম্যান, র্যালফ ওয়ালডো ইমারসন, ন্যাথানিয়েল হথর্ন, হারম্যান মেলভিল, এডগার এলান পো, ও’ হেনরি, মার্ক টোয়াইন উনবিংশ শতকে বিশ্বসাহিত্যের যে সেরা লেখা উপহার দিয়েছেন, তারই ধারাবাহিকতায় বিংশ শতকের প্রথমার্ধ পৃথিবীর কথাসাহিত্যকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন আমেরিকার লেখক উইলিয়াম ফকনার, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, জন স্টাইনবেক, এফ—স্কট ফিটজেরাল্ড, কুর্ট ভনেগাট জুনিয়র, জোসেফ হেলার প্রমুখ। টিএস এলিয়টও আমেরিকান কবি। কিন্তু চলে যান বৃটেনে, যেমন গিয়েছিলেন সিলভিয়া প্লাথ। তারা পৃথিবীর সাহিত্যকেই নিয়ে গেছেন একটি বিশেষ পর্যায়ে। এরপর নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ল্যাটিন আমেরিকান লেখকদের হাতে। সেটা অবশ্য এখানে আলোচ্য বিষয় নয়। বৃটেন, জার্মানি ও ফ্রান্সের মত আমেরিকাতেও দ্রুত গড়ে ওঠে হার্ভার্ড, ইয়েল, প্রিন্সটন, স্যানফোর্ড, কলাম্বিয়া, এমআইটির মত ক্লাসিকেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাদের শিক্ষা ও গবেষণা পরবতীর্ পর্যায়ে বিশ্বকে পাল্টে দিয়েছে।
আমেরিকা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সেভাবে জড়িত হয়নি, যেভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হয়। প্রধানত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিপুল সংখ্যক ইয়োরোপীয় মেধা চলে আসে আমেরিকায়। এদের মধ্যে ছিলেন প্রধানত ইহুদি দার্শনিক ও বিজ্ঞানী এবং গবেষক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই আইনস্টাইন আমেরিকায় চলে আসেন হিটলারের ইহুদি নিধনের আশংকায়। তার আপেক্ষিকতা তত্ত্বকে গ্রহণ করে রবার্ট ওপেনহাইমার ডিজাইন করেন প্রথম আণবিক বোমার। আমেরিকায় উড়োজাহাজ আবিষ্কার করেন দুই ভাই রাইট ব্রাদার্স ১৯০৩ সালে। সেই উড়োজাহাজ আবিষ্কারের ১৫ বছরের মধ্যেই তাকে একদিকে যাত্রী পরিবহন হিসাবে গড়ে তোলা হয়। তার পাশাপাশি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শত্রু দেশের টার্গেটে বোমা বর্ষণের হাতিয়ার হিসাবেও ব্যবহার শুরু হয়। মূলত তখন থেকেই ইয়োরোপের শক্তিধর দেশগুলোর পাশাপাশি আমেরিকা নিজের জায়গাটি তৈরি করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাত্র ২০ বছর পর পৃথিবী কোন্ দিক দিয়ে কতটুকু এগিয়ে গেছে তার হিসাবে আশাবাদের তেমন কোনো মাইলফলক দেখা না গেলেও যু্দ্ধাস্ত্র নির্মাণে যে অভূতপূর্ব অগ্রগতি লাভ করে তার প্রমাণ পাওয়া যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। এই যুদ্ধে হাওয়াইএর পার্ল হারবারে জাপানিরা আকস্মিক বোমা বর্ষণ করে আমেরিকার নৌবাহিনীর বিশাল ক্ষতি করলে, আমেরিকা এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা গোপনে শক্তিশালী আণবিক বোমা তৈরি করে ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে তা বর্ষণ করলে পৃথিবী নির্বাক ও স্তম্ভিত হয়ে যায়। আর আমেরিকা হয়ে দাঁড়ায় পৃথিবীর এক নম্বর সমরশক্তি। ফলে পৃথিবীর তাবৎ দেশ তৎকালীন সোভিয়েট ইউনিয়ন, চীনসহ আমেরিকাকে ভীতির চোখে দেখতে শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে অল্পবিস্তর হলেও এই যুদ্ধের পর থেকে আমেরিকার ম্যানুফ্যাকচারিং ব্যবসায় এক নম্বর হয়ে দাঁড়ায় অস্ত্র নির্মাণ এবং যুদ্ধ বিমান নির্মাণ সেক্টর।
তারপরও জ্ঞান বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা থেমে থাকেনি আমেরিকায়। বরং সম্প্রতিকালের জীবন পাল্টে দেয়া প্রযুক্তির প্রায় সবই উদ্ভাবিত এবং বিকশিত হয়েছে এবং হচ্ছে আমেরিকায়। শিক্ষা—দীক্ষা ও গবেষণার জন্য বিশ্বের প্রায় সব দেশের মেধাবীরা মুখিয়ে থাকে আমেরিকার উদ্দেশে। এসবই আমেরিকার গৌরবের জায়গা। আইনস্টাইন থেকে শুরু করে অনেক উদ্ভাবক ও বিজ্ঞানী এদেশে এসেছেন ইমিগ্রান্ট হিসাবে, তারপর এই দেশকে নিয়ে যাচ্ছেন উন্নতির শিখরে। এ সবই সম্ভব হয়েছে এদেশে শিক্ষার্জন ও গবেষণার সুবিধা ও উন্মুক্ত এবং উদার পরিবেশ এবং নিয়মের কারণে। আর এর জন্য সবচেয়ে বড় অবদান আমেরিকার কেন্দ্রীয় সরকারের। ফেডারেল সরকার এই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গবেষণাগারগুলোকে প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়। সেই অনুদানের অর্থ শেষ পর্যন্ত ফিরে যায় সরকারের কোষাগারেই। কারণ গবেষণার অধিকাংশ ফসল শেষ পর্যন্ত নতুন নতুন কনজ্যুমার প্রোডাক্ট। সেই প্রোডাক্ট বাজারে যায় এবং রেভিনিউ জেনারেট করে। শুধু আবিষ্কারই নয়, প্রোডাক্ট উন্নয়নেও কাজ করে।
পৃথিবীর সেরা ইউনিভাির্র্সটিগুলো লিবারেল আদর্শ ধারণ ও লালন করে। কিন্তু অত্যন্ত কট্টরপন্থী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে, সেই সাথে হাউজ, সিনেট ও সুপ্রিম কোর্টে তার দলীয় নিয়ন্ত্রণ পেলে তিনি এইসব ইউনিভার্সিটির ফেডারেল বরাদ্দ ও বিশেষভাবে গবেষণা খাতে বরাদ্দ কোথাও সম্পূর্ণ বন্ধ, কোথাও আংশিক কাট করায় অত্যন্ত সংকটে পড়ে গেছে সেইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অনেক ইউনিভার্সিটি গবেষকদের আর চাকরিতে রাখতে পারছে না। অনেক ইউনিভার্সিটি অর্থাভাবে অনেক প্রফেসরকে হয় ছুটি দিচ্ছে, নয়ত বা এডজাংক্ট হিসাবে নিয়োগ দিচ্ছে।
এছাড়াও বিদেশী ছাত্রদের স্টুডেন্ট ভিসায় কড়াকড়ি করায়, এবং এইচ—ওয়ানবি ভিসায় নতুন শর্ত জুড়ে দেয়ায় এদেশের শিক্ষাখাত আশংকার মধ্যে পড়ে গেছে। আর গবেষক, স্কলাররা পড়েছেন চরম হতাশায়। ফেডারেল জব নিয়ে চলছে ফুটবল খেলা। একইভাবে এই নির্বিবাদী এবং অসীম মেধাবী মানুষগুলো হতাশ হয়ে পড়েছেন।
গত সপ্তাহে সিএনএন একটি খবর দিয়েছে। খবরে বলা হয়েছে, এই স্কলার ও গবেষকরা আমেরিকায় তাদের ভবিষ্যত না দেখতে পাওয়ায় চলে যাচ্ছেন চীনে। দুই বছর আগেও ২০২৩ সালে চীন তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যয় করেছে ৭৮০ বিলিয়ন ডলার। আমেরিকার গত বছরের গবেষণা ও উন্নয়ন ব্যয় ছিল ৮২৩ বিলিয়ন ডলার। ফলে দুই দেশের একই খাতে ব্যয় বরাদ্দের পার্থক্য বেশ কম। সিএনএন তাদের সম্প্রতিকালের এক সমীক্ষার বরাত দিয়ে জানিয়েছে ২০২৪ সালে ৮৫ জনেরও বেশি আমেরিকান গবেষক চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছে। ২০২৫ এ এই সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। আগামী বছর, ধারণা করা হয়েছে, এই সংখ্যা আরো বাড়বে।
প্রায় প্রতিটি দেশের আইন প্রণয়নকারীরা এবং সেসব দেশের সুশীল সমাজ চায় শিক্ষা খাতে বরাদ্দ যেন বর্তমানে যা আছে তার চেয়ে বাড়ানো হয়। আমেরিকাতে সামরিক খাতের খরচ কমিয়ে শিক্ষা ও গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবিও বারবার ওঠে। বাড়ানোও হয়। সেই ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানোর যে ফলশ্রম্নতি কী হয় তাও দেখা হয়। এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানকে এর জন্য জবাবদিহি করতে হয়।
প্রেসিডেন্ট ‘আমেরিকাকে আবার গ্রেট’ বানাতে চান। এটা তার শ্লোগান। কিন্তু একটা দেশ কীভাবে গ্রেট হয় শিক্ষার বিকাশ ও গবেষণা রুদ্ধ করে দিলে? এখানে আরেকটি বিষয় জানাও বেশ জরুরী। প্রেসিডেন্ট তার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছেন। কিন্তু গ্রান্ড ওল্ড পার্টি হিসাবে পরিচিত রিপাবলিকান পার্টির স্বনামধন্য এবং ডাকসাইটে রাজনীতিক ও নীতি নির্ধারকরা কেন প্রেসিডেন্টকে থামাচ্ছেন না?
এটা নিশ্চিত, আজকে যা ঘটছে, তার প্রতিফল কালই পাওয়া যাবে না। আজকের এই ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া লক্ষণীয় হয়ে উঠবে আগামী ৫, বা ১০ বা ১৫ বছর পরে। তখন কি বিশ্ববাসী বলতে পারবে আমেরিকা শিক্ষা—দীক্ষা ও শৌর্য—বীর্যে পৃথিবীর সেরা?