অবশেষে চলে গেলেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

বিবিসি বাংলাঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক এবং লেখক, সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মারা গেছেন। শুক্রবার বিকেল ৫টার দিকে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
গত ৩ অক্টোবর ঢাকার ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশে (ইউল্যাব) যাওয়ার পথে গাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। পরে তাকে পার্শ্ববর্তী একটি হাসপাতালে এবং সেখান থেকে ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরীক্ষা—নিরীক্ষার করে চিকিৎসকরা জানান, তার ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। এরপর অস্ত্রোপচার করে হার্টে স্টেন্টিং করা (রিং পরানো) হয়।
এর পর থেকেই সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে বলে চিকিৎসকরা জানিয়ে এসেছেন। তার অক্সিজেন লেভেল কমতে থাকে, ফুসফুসে পানি জমতে শুরু করে। পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে থাকলে রবিবার সন্ধ্যায় তাকে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়।
প্রায় ৪৮ ঘণ্টা লাইফ সাপোর্টে থাকার পর তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। তবে পরে আবার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে পুনরায় লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়। শুক্রবার বিকেল ৫টায় চিকিৎসকেরা লাইফ সাপোর্ট সরিয়ে নিয়ে তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে জানা যায়।
মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করার কথা রয়েছে।
লেখক হিসেবেই বেশি পরিচিতি পেয়েছিলেন
শিক্ষাবিদ পরিচয় ছাড়াও সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের বিচরণ ছিল বাংলা সাহিত্য ও মুক্ত চিন্তার জগতে। লেখক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক হিসেবেও ব্যাপক পরিচিত তিনি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন ৪৩ বছর। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির ইমেরিটাস অধ্যাপক ছিলেন।
সত্তরের দশকে বাংলার সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় এই শিক্ষক ও লেখকের। এরপর দেড় দশকের দীর্ঘ স্বেচ্ছা বিরতি দিয়েছিলেন। তবে আশির দশকে আবার একেবারে ভিন্ন রূপে সাহিত্যে পদচারণা শুরু করেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। এবার লেখালেখির জগতে বিশেষত ‘গল্পে’ নিয়মিত হন এই লেখক।
কোনো দশকওয়ারি বিভাজনে না পড়েও বাংলা গল্প সাহিত্যের প্রথম সারির একজন লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
জন্ম, শৈশব ও শিক্ষা জীবন
সিলেটে ১৯৫১ সালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা সৈয়দ আমীরুল ইসলাম ও মা রাবেয়া খাতুন। সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ সালের মাধ্যমিক পাস করেন তিনি। দুই বছর পরে সিলেট এমসি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭১ সালে স্নাতক ও পরের বছরই বাহাত্তর সালে স্নাতকোত্তর শেষ করেন।
কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮১ সালে পিএইচডি করেন তিনি।
কর্মজীবন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে মূল পেশাগত জীবন পার করেছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন তিনি। দীর্ঘদিনের কর্মজীবন শেষে ২০১৭ সালের জুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অবসর নেন। এরপর ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ২০২৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ‘ইমেরিটাস অধ্যাপক’ করে। ব্যক্তি জীবনে এক সন্তানের জনক লেখক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম। ছেলে এখন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন।
শিক্ষার্থীদের ‘এসএমআই’ স্যার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষার্থীদের কাছে মনজুরুল স্যার বা নামের আদ্যোক্ষর দিয়ে এসএমআই স্যার নামে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন তিনি।
শিক্ষার্থীরা মনে করেন, এই শিক্ষকের রয়েছে ছাত্রকে চমকে দেওয়ার বিস্ময়কর ক্ষমতা।
লেখক আনিসুল হকের স্ত্রী মেরিনা ইয়াসমীন ছিলেন তার ইংরেজী বিভাগের ছাত্রী।
এক লেখায় আনিসুল হক লিখেছেন, ‘তিনি যখন বৃত্তি নিয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিদেশে যাবেন, তখন ছাত্রছাত্রীরা ভীষণ কান্নাকাটি করেছিলেন। সংবর্ধনার অনুষ্ঠানটিতে অভিনন্দন জানানোর উচ্ছ্বাসের জায়গা দখল করেছিল শিক্ষার্থীদের অশ্রুপাত।’
পুরস্কার ও পদক
গল্পকার সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৮ সালে পান একুশে পদক। ১৯৯৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘নন্দনতত্ত্ব’ বইটির জন্য।
‘প্রেম ও প্রার্থনার গল্প’ এর জন্য পেয়েছেন ১৪১১ সালের প্রথম আলো বর্ষসেরা বই’ এর পুরস্কার এবং কাগজ সাহিত্য পুরস্কার—২০০৬।
বাংলা সাহিত্যে তার অবদানের জন্য ২০১৬ সালে কাজী মাহবুবুল্লাহ পুরস্কারে ভূষিত হন।