গল্প || প্রেমপত্র || শফিউল আলম, নিউইয়র্ক

হ্যালো, কে বলছেন? আপনার কথা কেটে যাচ্ছে। লাইনটা কেটে আবার কল করুন। এই বলে অনিরুদ্ধ ফোন রাখতে যাবে, সেই মুহূর্তে ওপাশ থেকে চিৎকার করে বলল, এই শালা, অমিতকে চিনতে পারলি না?

অনিরুদ্ধ একটু থতমত খেয়ে বলল

কোন অমিত?

যাহ, শালা, স্কুলের দোস্তের কথা ভুলে গেলি?

মনে পড়ে গেল অনিরুদ্ধের। বন্ধুদের মধ্যে সেই ছিল কাছের। 

তুই কোথায়?

ভার্জিনিয়াতে। তোর ঠিকানাটা পাঠিয়ে দে। পরশু আমি নিউইয়র্কে যাবো। দেখা হবে। অনেক কথা জমে আছে। 

কথা শেষে ফোনটা রেখে দিলো অনিরুদ্ধ। অমিতের চেহারাটা ভেসে উঠলো স্মৃতির পটে। 

কত স্মৃতি। অজান্তেই হাসি এলো তার। 

স্কুল জীবনে ছিলো সবচেয়ে কাছের। অনিরুদ্ধদের বাসার মাঠে বসে আড্ডা দিতো। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতো ফেরিওয়ালা। হেঁটে যেতো গোয়ালা দুধ নিয়ে। পা চালিয়ে চলতো বাড়ি ফেরার মানুষগুলো। 

রাস্তার ওপাশে ছিল তারকাঁটা দিয়ে ঘেরা পুকুর। তার পাশে একটা শিমুল ফুলের গাছ। বিকেল হলে একটা মেয়ে এসে বসতো ঘাটের পাড়ে। 

এমনি একটা দিন। মেয়েটা দাঁড়িয়ে ছিলো শিমুল গাছের নিচে। অনিরুদ্ধ আর অমিত বসেছিল মাঠে। আলাপ করছিল আসছে বোর্ড পরীক্ষা নিয়ে। দুজনেই দশম শ্রেণীর ছাত্র। 

হঠাৎই ঘাড় ফিরিয়ে অমিত তাকালো মেয়েটির দিকে। 

মেয়েটি কে রে? চিনিস নাকি?

চিনি, তবে পরিচয় নেই। বলল অনিরুদ্ধ। 

কার মেয়ে? আমি দেখিনি কেন আগে?

আলমগীর চাচার মেয়ে। তুই চিনবি কি করে? তুই তো থাকিস আরেক পাড়ায়। 

কোন ক্লাসে পড়ে?

নবম শ্রেণীতে। 

তুই এতো খবর জানিস কিভাবে?

কারণ সে আমার পাড়ার মেয়ে। জানতে হয়। 

আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবি?

তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হলে তো আমার সাথে পরিচয় থাকতে হবে। তাই না? পরিচয় নেই তবে নামটা জানি। বলে হাতের পাশে পরে থাকা একটা কাঠি ছঁুড়ে দিলো রাস্তার দিকে। 

কি নাম? জানতে চাইলো অমিত। 

সঙ্গীতা।

তা এই সঙ্গীতার সাথে আমি কিভাবে পরিচিত হবো, দোস্ত? আচ্ছা ভাল কথা, আমি যদি একটা প্রেমপত্র পাঠাই তাহলে কেমন হয়। একটু উত্তেজিত হয়েই অমিত বলল কথাটা। শুধু তাই নয়, উঠে একটু পায়চারি করে নিলো। 

তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? চিঠি অন্য কারো হাতে পড়লে, সর্বনাশ। আর লিখবে কে? বলে অনিরুদ্ধ তাকালো অমিতের দিকে। 

কেন? তুই লিখে দিবি। আমি তো বাংলায় টেনে টুনে পাস করি। তোর লেখার হাত ভাল। হাতের লেখাও ভাল। 

না না আমি ওসবের মধ্যে নেই। 

সে নাছোড়বান্দা। অগত্যা অনিরুদ্ধকে লিখতে বসতে হলো। 

সে লিখলো

আমার হৃদয় মনি

তোমাকে যখনি দেখি শিমুল গাছের নিচে, আমার হৃদয় নেচে ওঠে। তুমি আগামীকাল স্কুল শেষে এসো দুর্গা পূজোর মন্ডপে। আমাকে চিনতে অসুবিধা হবে না। আমার পরনে থাকবে সাদার উপর কালো ফোঁটা দেওয়া জামা। 

ইতি

তোমার অনুরাগী

অমিত চুপ করে শুনলো। কোনো কথা বলছে না। 

কিরে কিছু বলছিস না যে? পছন্দ হয়নি? অনিরুদ্ধ জানতে চাইলো। 

হয়েছে, তবে যে একটা গান আছে না, কি যেন, যে, হৃদয়ের মধ্যে দেখানো, ছাই, আমার কি এসব মনে থাকে। মাথার চুল টানতে টানতে বলল। 

হেসে উঠল অনিরুদ্ধ। বুঝতে পেরেছি, সতীনাথের গাওয়া। 

হৃদয় চিরে যদি, দেখাতে পারিতাম..

বুঝিতে তুমি ওগো..

কি যে তারই দাম

হ্যাঁ হ্যাঁ, ঐটা একটু জুড়ে দে। 

তা তো দিলাম, কিন্তু চিঠিটা পৌছাবে কে? অনিরুদ্ধ একটু চিন্তিত হয়ে কথাটা বলল। 

তাহলে? অমিত হতাশ হয়ে বলল। 

দেখি কি করা যায়। আমার ছোট বোন সঙ্গীতার বোনের বান্ধবী। 

একটু তাড়াতাড়ি কর দোস্ত। 

অবশেষে অনিরুদ্ধ তার বোনের হাতে দিয়ে চিঠিটা পাঠিয়ে দিলো। বুঝিয়ে বলে দিলো কাকে দিতে হবে। 

অমিত নির্দিষ্ট দিনে পূজার মন্ডপে এলো। 

কিন্তু সঙ্গীতা এলো না। 

দুপুর পেরিয়ে বিকেল হলো। অবশেষে অস্থিরভাবে মন্ডপ থেকে অমিত সোজা এলো অনিরুদ্ধের কাছে। 

উসকোখুসকো চুল। 

অনিরুদ্ধ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, দেখা হয়েছে?

দেখা হয়নি শুনে অনিরুদ্ধ অমিতকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো। 

তারপর এলো বোনের কাছে। 

জিজ্ঞাসা করল, চিঠিটা সঙ্গীতাকে দিয়েছে কিনা। 

সে বলল, সঙ্গীতা বাসায় ছিল না। ওর বাবা ওর কাছ থেকে নিয়ে বলেছে সঙ্গীতাকে সে দিয়ে দেবে। 

কি সর্বনাশ, মাথায় বাজ পড়ল অনিরুদ্ধের। 

চিঠিতে কোনো জায়গায় অমিতের নাম নেই। তারপর অনিরুদ্ধের বোনের হাত দিয়ে পাঠানো। অনিরুদ্ধের মাথা ঘুরপাক খেতে লাগল। কি করবে সে? সামনে পরীক্ষা। মন দিতে পারছে না বইয়ের পাতায়। 

সারারাত ঘুম এলো না। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। পানি খেলো কয়েকবার। 

সকাল থেকেই তাড়াহুড়ো করে স্কুলের দিকে রওনা দিলো। মা জিজ্ঞেস করেছিল এতো সকালে কেন স্কুলে যাচ্ছে। 

উত্তরে বলেছিল, মহিত স্যার সকালে আসে কোচিং করাতে, উনার কাছ থেকে একটা অংক বুঝতে হবে। 

আসলে সে সোজা এলো অমিতের বাসায়। বলল, সবকিছু। অমিতের মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না। 

স্কুল শেষে বাসায় ঢুকতেই দেখতে পেলো সঙ্গীতার বাবা বসে আছে ড্রইংরুমে। 

অন্য দরজা দিয়ে ঢুকতে যাবে, বাবা ডাক দিলো। শরীর কাঁপছে। সামনে এসে দাঁড়াল। সঙ্গীতার বাবার মুখের দিকে চাইতে পারলো না। দেখলো চিঠিটা টেবিলের উপর। 

চিঠি তুমি লিখেছো? বাবা জানতে চাইলো। 

হ্যাঁ, তবে

কথা শেষ করতে দিলো না। 

বাবা বলল, আমি অন্য কিছু শুনতে চাইনি। হাতের লেখাটা তোমার কিনা জানতে চেয়েছি। 

জি, আমার। 

সামনে বোর্ড পরীক্ষা, সেটা মনে আছে কি?

আছে। মাথা নিচু করে বলল অনিরুদ্ধ। 

এসবে মন না দিয়ে, পড়াশুনায় মন দাও। ভালো রেজাল্ট না করলে ভালো কলেজে ভর্তি হতে পারবে না। এখন যাও। বলে চিঠিটা হাতে নিয়ে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলল। 

অমিতের প্রেম ফুটতে না ফুটতেই মিলিয়ে গেল কর্পূরের মত। 

অমিত আর অনিরুদ্ধ আর কোনদিন বসেনি মাঠে। সঙ্গীতা আর কোনদিন এসে দাঁড়ায়নি শিমুল গাছের নীচে। 

রেজাল্ট বের হলো। দুজনেই ভালো করেছে। চলে গেল দুজনে দুই শহরে। 

এরপরও যোগাযোগ ছিল। তবে আস্তে আস্তে ম্লান হয়ে এলো। অনিরুদ্ধ পাড়ি দিলো একদিকে। অমিত চলে গেল অন্য দেশে। 

স্মৃতি মন্থন করছিল অনিরুদ্ধ। ফোন বেজে উঠলো। প্রতিদিন এই সময় ছেলে ফোন করে। তার একটু পরে করবে মেয়ে। 

আব্বু, সব ঠিক আছে? জানতে চাইলো আশিক। 

হঠাৎ অনিরুদ্ধের মনে হলো আচ্ছা আশিকদের জেনারেশন কি প্রেমপত্র লেখে। জানতে অসুবিধা কি। সব রকম কথাই তো হয় ওদের সাথে। 

আচ্ছা, আশিক, তোমরা যখন ডেটিং করতে তখন কি কোন সময় প্রেমপত্র লিখেছ? জিজ্ঞাসা করল অনিরুদ্ধ। 

হোয়াট?

না মানে, লাভ লেটার লিখেছ কিনা। 

আর ইউ ওকে? ভয়ার্ত স্বর। 

হোল্ড অন, বলে টেলিফোনটাকে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ করে রাখল আশিক। 

তারপর ওপাশ থেকে মেয়ে সুস্মিতার কন্ঠ ভেসে এলো। 

হোয়াট হ্যাপেনড, আব্বু? সুড আই কাম নাও?

আরে বাবা না। আমি ঠিক আছি। আমি শুধু জানতে চেয়েছিলাম — 

ডু ইউ রাইট লাভ লেটার? মেয়ের স্বরে বিস্ময়। 

আরে বাবা না, এতো মহা ফ্যাসাদ দেখছি। শুধু জানতে চেয়েছি। 

নো, উই ডোন্ট ডু দ্যাট। ওকে? উই ডোন্ট রাইট লাভ লেটার। সুস্মিতা হাসতে হাসতে বলল। 

ওকে। বলে অনিরুদ্ধ অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বলতে থাকলো। এক পর্যায়ে ওরা বলল, মাথার মধ্যে আজেবাজে চিন্তা এনো না আব্বু, তাতে তোমার শরীর খারাপ হবে। 

দুটো দিন কোথা দিয়ে পার হয়ে গেল। 

অমিত কল করেছিল। বিকেলে এসে পৌছাবে। অনিরুদ্ধ পাশের ঘরটা প্রিসিলাকে দিয়ে পরিষ্কার করে রেখেছে। 

সাধনার কাছ থেকে আনিয়ে রেখেছে মাছ মাংস। ভাল রান্না করে সে। 

সন্ধ্যা হয়ে এলো। সূর্য ডুবতে এখনো কিছু সময় বাকি। 

পায়চারি করতে থাকলো অনিরুদ্ধ। 

ঠিক সেই সময়ে কলিং বেল বেজে উঠলো। 

অনিরুদ্ধ দরজাটা খুলে দাঁড়াল। 

পশ্চিমে ডুবতে যাওয়া সূর্যের লালচে আভা এসে পড়েছে অমিতের পাশে দাঁড়ানো মহিলার ওপর। 

অনিরুদ্ধ তাকালো মহিলার দিকে। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। 


Related Posts