গাজার যুদ্ধ বিরতি চুক্তি || সত্যিই কি উড়বে শান্তির পতাকা?

এএফপি, ওয়াশিংটনঃ হোয়াইট হাউজে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠক টেলিভিশনে সম্প্রচার হচ্ছিল। হঠাৎই সে বৈঠকের মাঝখানে ঢুকে পড়েন সেক্রেটারি অব স্টেট মার্কো রুবিও। তিনি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতে একটি চিরকুট দিয়ে কানে কানে বলেন, শিগগিরই গাজা চুক্তি হতে যাচ্ছে। এটি ছিল ট্রাম্পের জন্য একটি নাটকীয় মুহূর্ত, যিনি কিনা জনসমক্ষে নিজেকে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী’ হিসেবে উপস্থাপন করতে পছন্দ করেন।
কিছুক্ষণ পরই ট্রাম্প তাঁর নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন, তাঁর প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপ বাস্তবায়নে একমত হয়েছে হামাস ও ইসরাইল।
এ ঘটনা যখন ঘটল, তখন ওভাল অফিসে এএফপিসহ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকরাও উপস্থিত ছিলেন। তবে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁকে চাপ দেওয়া কিংবা আরব দেশগুলোর মন জয় করা—যুদ্ধবিরতির জন্য ট্রাম্পের বেশির ভাগ কূটনৈতিক প্রচেষ্টাই ছিল দৃশ্যপটের আড়ালে।
নেতানিয়াহুর ওপর চাপ
নোবেল শান্তি পুরস্কার জেতার আশা এবং নিজের কৃতিত্ব জোরদার করার প্রবল আকাক্সক্ষা নিয়ে এবার ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরাইলের সামনে একেবারেই ভিন্নরূপে হাজির হন ট্রাম্প।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর ট্রাম্প তাঁর ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা প্রস্তাব উন্মোচন করতে নেতানিয়াহুকে হোয়াইট হাউজে আমন্ত্রণ জানান। এ সময় তিনি প্রকাশ্যে নেতানিয়াহুকে পুরোপুরি সমর্থন দিচ্ছেন বলে দেখানোর চেষ্টা করেন। ট্রাম্প বলেন, হামাস যদি পরিকল্পনা মেনে না নেয় তবে ইসরাইলকে তাদের কার্যসিদ্ধি করতে ও হামাসকে ধ্বংস করে দিতে পূর্ণ সমর্থন দেবেন। কিন্তু গোপনে ট্রাম্প আসলে নেতানিয়াহুকে চাপ দিয়ে আসছিলেন।
প্রথমত, ট্রাম্প নেতানিয়াহু ও ইসরাইলি নেতাদের সামনে যে পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছিলেন, তা এর আগের সপ্তাহেই আরব ও মুসলিম বিশ্বের নেতাদের সঙ্গে বসে আলোচনার সময় প্রস্তুত করা হয়েছিল। পরিকল্পনাটি নেতানিয়াহুর সামনে উপস্থাপন করার পর তিনি দেখলেন, এতে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, যা তিনি মেনে নেওয়ার পক্ষে নন। বিশেষ করে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নেওয়া।
কাতারে হামলাকে কেন্দ্র করে আরব বিশ্বের ঐক্য
যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশ কাতারে গাজা যুদ্ধবিরতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলার সময় হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে ইসরাইলি হামলার ঘটনায় ট্রাম্পও ব্যক্তিগতভাবে ক্ষুব্ধ হন। ট্রাম্প ওই হামলার বিরুদ্ধে আরব দেশগুলোর ঐক্যকে কাজে লাগিয়ে শান্তি পরিকল্পনা মেনে নিতে তাদের রাজি করিয়েছেন।
ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে একরকম ফাঁদে ফেলে ওভাল অফিস থেকে কাতারের নেতাদের কল করে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেন। হোয়াইট হাউজ থেকে প্রকাশিত এক ছবিতে দেখা যায়, নেতানিয়াহু টেলিফোনে কাতারের নেতাদের কাছে ক্ষমা চাইছেন। আর ট্রাম্প নিজেই টেলিফোন সেট ধরে বসে আছেন।
পলিটিকো জানিয়েছে, ওই ফোনালাপের সময় কাতারের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ওভাল অফিসে উপস্থিত ছিলেন, যাতে নেতানিয়াহু নির্ধারিত বক্তব্যের বাইরে কিছু না বলেন। পরে ট্রাম্প কাতারকে মার্কিন নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেন।
ট্রাম্পের কূটনৈতিক অবস্থানের এমন পরিবর্তন আরব দেশগুলোর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রতিচ্ছবিও বটে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দুই মেয়াদেই তিনি আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করেছেন।
ট্রাম্প প্রথমবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মরক্কো আব্রাহাম চুক্তি স্বাক্ষর করে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়। আর এবার ট্রাম্প তার প্রথম বড় বিদেশ সফরে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ দেশ কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত গেছেন। এ সফরে তিনি ইসরাইলে যাননি। এটি ইঙ্গিত দেয়, ট্রাম্প আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ককে বিশেষ প্রাধান্য দিচ্ছেন।
হামাসের প্রস্তাব লুফে নেওয়া
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের ওপরও ক্রমাগত চাপ বাড়িয়েছেন ট্রাম্প। সবশেষ তিনি সংগঠনটিকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছেন। এ সময়ের মধ্যে শান্তিচুক্তি না করলে তাদের ‘নরক যন্ত্রণা’ ভোগ করতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
গাজায় আটক জিম্মিদের মুক্ত করতে ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতিকে কাজে লাগিয়ে কৌশলে এ হুঁশিয়ারির জবাব দেয় হামাস। তারা সব জিম্মিকে মুক্তি দিতে প্রস্তুত বলে একটি বিবৃতি দেয়। ট্রাম্প তৎক্ষণাৎ ওই বিবৃতিকে তাঁর কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে লুফে নেন।
এ সময় ট্রাম্প নজিরবিহীন একটি কাজ করে বসেন। ওয়াশিংটন যাকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছিল, সেই হামাসের বিবৃতিটি তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন। তিনি ইসরাইল, হামাস ও মধ্যস্থতাকারীদের দ্রুত চুক্তির বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে চাপ দেন।
ট্রাম্প মার্কিন সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওসকে বলেন, তিনি নেতানিয়াহুকে বলেছেন, ‘বিবি (বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সংক্ষেপ), এটা তোমার জয়ের সুযোগ। তিনি এটা মেনে নিয়েছিলেন। তাঁকে এটা মেনে নিতেই হতো। তাঁর হাতে কোনো উপায় ছিল না। আমার সঙ্গে থাকতে হলে মেনে নিতেই হবে।’