ক্রান্তিকাল—৭৯ || হাসানআল আব্দুল্লাহ

৯৫

এরই মাঝে করোনা সংক্রান্ত আইসোলেশন অনেকটা শিথিল হয়ে আসে। লকডাউন তুলে দেয়া হয়। তবে রেস্টুরেন্টে ভেতরে বসার অনুমতি দেয়া হয় না। ফলে শহরের অনেক রেস্টুরেন্টই বাইরে ব্যালকনির মতো বানিয়ে নেয়। অন্যান্য ব্যবসাও আস্তে আস্তে খুলতে শুরু করে। তবে অসংখ্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ইতিমধ্যে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। কিন্তু দিনে দিনে রাস্তায় যানবাহনের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এমতাবস্থায় আপনারা সিদ্ধান্ত নেন যে দুচার দিনের জন্যে শহরের বাইরে থেকে ঘুরে আসবেন। সেক্ষেত্রে আপনাদের যাবার মতো একটি চমৎকার জায়গা হলো নিউইয়র্ক শহর থেকে দুশপঞ্চাশ মাইল দূরের অ্যালমায়রা শহর। পাহাড় ঘেরা একটি মনোরম জায়গা। বিশেষ আকর্ষণ হলো মার্ক টোয়েন একসময় ওখানে গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতেন। লেখালেখি করতেন। বিখ্যাত উপন্যাস হাকেলবেরি ফিন টম সয়ার নাকি ওখানে বসেই লেখা। তাঁর লেখার ঘরটি স্থানীয় কলেজ সংস্কার করে পুরোটা ধরে এনে নিজেদের ক্যাম্পাসে বসিয়ে দিয়েছে, যেখানে দর্শনার্থীরা নিয়মিত আসেন, বিখ্যাত এই লেখকের ব্যবহৃত জিনিসপত্রের সংস্পর্শে আনন্দ পান। প্রতিবছর মার্ক টোয়েন মেলাও হয়। আরেকটি কারণেও এই শহর বিখ্যাত তাহলো নিউইয়র্ক স্টেট প্রিজন। পাহাড়ের উপরে বিশাল জেলখানায় স্টেটের ধাড়ি ধাড়ি সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের আটক রাখা হয়। তবে সেটা কিন্তু একেবারেই বোঝা যায় না। বাংলাদেশের মতো এখানে কারাগারের আশেপাশে ভিড় করার কোনো নিয়ম নেই। আসামিদের সাথে কেউ দেখা করতে এলে সেটাও ভিসিনিটির ভেতরে গাড়ি নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে পার্ক করে নিয়ম মেনে করতে হয়। ফলে কেউ যদি না জানে যে এখানে এতোবড় একটি কারাগার রয়েছে তার পক্ষে কোনো অবস্থাতেই বোঝার উপায় থাকে না। 

মার্ক টোয়েন কিম্বা স্থানীয় কারাগার কোনোটাই আপনার বা আপনাদের আকর্ষণের বিষয় নয়। আকর্ষণের মূলে রয়েছে এই শহরের একটি ছিমছাম বাড়ি, যা আপনি প্রায় বছর দশেক আগে সামারের ছুটি কাটানোর জন্যে কিনেছিলেন। কিন্তু নিউইয়র্ক থেকে এতো দূরে কেন বাড়ি কিনতে গেলেন? তারও একটি ভাল উত্তর আপনার কাছে আছে। গ্রামে বড় হওয়ায় আপনার বড় বাড়ি সব সময়ই পছন্দ। কিন্তু শহরে আপনি যে বাড়িতে থাকেন তার সামনে পিছনে সামান্যই জায়গা, তারপরেও একপাশ অন্য বাড়ির সাথে যুক্ত, যাকে বলে সেমি এটাচড। কিন্তু অ্যালমায়রা শহরে আপনার বাড়িটি সিকি একর জায়গার ওপর বেশ মনোরম, কিনেছিলেনও নামমাত্র মূল্যে। সেই মূল্যও পরিশোধ হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। 

জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিজে উঠে হঠাৎ করেই আপনি দেখলেন গাড়িতে তেল নেই। মনে মনে ভাবলেন, হায় হায় রওনা দেয়ার আগে কেন দেখিনি! দ্বিতীয় ছিলো পিছনের সিটে বসা, আর আপনার স্ত্রী বসেছেন আপনার পাশে প্যাসেঞ্জার সিটে। আপনি বললেন, ‘দ্যাখ তো কাছাকাছি কত দূরে গ্যাস স্টেশন আছে? তেল শেষ আমি আগে লক্ষ্য করিনি!’

যেতে থাকো সামনে গিয়েই পাবা!’ প্রায় সাথে সাথেই উত্তর দিলে দ্বিতীয়।

পাঁচ সাত মাইল চালানোর মতো তেল আছে।আপনি স্বগতউক্তি করলেন।

তিন মিনিটের ভেতরেই পৌঁছে যাবা গ্যাস স্টেশনে।দ্বিতীয় আপনাকে আশ্বস্ত করলো।

ওর দেয়া ডিরেকশন অনুসরণ করেই আপনি ব্রি্রজ থেকে নেমে ডান দিকে গেলেন। ইন্টারস্টেট ৮০ লোকালে একটু এগিয়েই এক্সিট নিয়ে গ্যাস স্টেশন পাওয়া গেল। আপনি তেল ভরতে থাকলে লতা দ্বিতীয় নেমে স্টেশনের ভেতরের দোকানে গেল। এসে লতা ঘোষণা দিলেন, ‘এদের বাথরুম এতো নোংরা যে তুমি ব্যবহার করতে পারবে না।

ততক্ষণে আপনার তেল ভরা শেষ হয়েছে। নিউজার্সিতে আসলে গ্যাস নিজে পাম্প করতে হয় না। স্টেটের নিয়ম অনুসারে প্রতিটি গ্যাসস্টেশনে লোক থাকে তেল পাম্প করে দেবার জন্যে। নিউইয়র্কে সেই ব্যবস্থা না থাকায় আপনি ক্রেডিট কার্ড ঢুকিয়ে গ্যাস নিতে থাকলে একজন কর্মচারী পাশে এসে দাঁড়ালেন, এবং আপনাকে গ্যাস ঢুকাতে দেখে কিছু না বলে তিনি অন্য গাড়িকে সার্ভিস দেবার জন্যে এগিয়ে গেলেন। অতএব আপনি নিজে নিজেই কাজটা শেষ করে ট্যাঙ্কের ঢাকনা লাগানোর সময় আপনার স্ত্রী সন্তান ফিরে এলো।কিন্তু আমার যে যেতে হবে!’ আপনি প্রকৃতির তাড়া অনুভব করছেন।

ওদের বাথরুমে টিস্যু পর্যন্ত নেই!’ লতা আপনাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলেন।

কিন্তু আমাকে যেতেই হবে,’ আপনি স্টোরের দিক এগোলেন।

বাথরুম আপনার কাছে এতোটা খারাপ লাগলো না। টিস্যু ছিলো না ঠিকই, কিন্তু লতা যেমন বললেন ততটা নোংরাও নয়। তাছাড়া ফ্লাশও করা গেল।

আপনি একটা চা নিয়ে ফিরে এসে আবারও স্টিয়ারিং হুইল ধরলেন। দ্বিতীয় গুগল ম্যাপ দেখে বললো, ‘চলো তোমাকে আগে এখান থেকে বের করে হাইওয়েতে তুলে দেই।

কিন্তু ওর ডিরেকশন অনুসরণ করে আপনি যেসব রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটালেন সেসব রাস্তায় আগে কোনো দিন আসেননি। শেষ পর্যন্ত ইন্টারস্টেট ১৭তে উঠে বললেন, ‘তাই তো বলি এতো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নিয়ে এলো কেন। এটা তো আই৮০ নয়! রাস্তা তো ছোট, গাড়ি চালিয়ে মজা পাওয়া যাবে না।

আমাকে দিতে পারো। আমার কোনো সমস্যা নেই।দ্বিতীয় বললো। কিন্তু ছেলে গাড়ি চালালে আপনার সমস্যা আছে। সে গাড়ি বেশ জোরে চালায় যা আপনার পছন্দ নয়। 

আপনি বললেন, ‘এই পথে আগে একবারই এসেছি। সমস্যা নেই, তুমি পরে চালাও। আগে আমি খানেক মাইল চালাই।

হাইওয়েতে আগের থেকে গাড়ি বেশ কম। তবে পেনসিলভেনিয়ার একটি রেস্ট এরিয়ায় খেতে নেমে দেখলেন কারো মুখেই মাস্ক নেই। আপনি স্বগতউক্তি করলেন, ‘সামার যেতে না যেতেই আবার করোনা বিপুলভাবে হানা দেবে।খাওয়া শেষ করে ওখানে বাথরুম সেরে ছেলের হাতে স্টিয়ারিং হুইল দিয়ে আপনি প্যাসেঞ্জার সিটে বসলেন। লতা এবার চলে গেলেন পিছনের সিটে। এমনিতে দ্বিতীয় লতার ভেতরে সব সময় প্রতিযোগিতা হয় কে পিছনে বসবে তাই নিয়ে। সামনে দুজনের একজনও বসতে চায় না। কিন্তু দ্বিতীয় গাড়ি চালালে, সামনের সিটটি ওর মা আপনাকে ছেড়ে দেন। 

দ্বিতীয় বেশ জোরে গাড়ি টানছিলো। কোনো অবস্থাতেই আশি মাইলের নিচে নামছিলো না। ওদিকে সামনে বসে আপনার ভয় করতে লাগলো। একবার আপনি বলেও ফেললেন, ‘আস্তে চালাও।কিন্তু দ্বিতীয় ড্রাইভিং সিট থেকে হাত ইশারায় আপনাকে কথা বলতে বারণ করলো। আপনিও ভাবলেন গাড়ি চালানোর সময় ওকে বিরক্ত না করাই ভাল। কিন্তু কিছু দূরে গিয়ে একটি লরিকে অতিক্রম করার পর আপনি বলতে বাধ্য হলেন যেআমাদের তো কোনো তাড়াহুড়ো নেই, একটু আস্তে চালালেই চলে।দ্বিতীয় আপনার কথা শুনে গাড়ি আরো জোরে টানতে লাগলো এবং মুখে বললো, ‘তুমিও এতো জোরেই চালাচ্ছিলে।এই এক সমস্যা, তরুণদের রক্ত গরম। গাড়িতে উঠলে ওরা মনে করে যত দ্রুত যাওয়া যাবে ততই ভাল। আদতে গাড়ি চালানো মানে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানো, দ্রুত চালানো নয়, সেটা ওদের বোঝানো যায় না। অগত্যা আপনি রণে ভঙ্গ দিয়ে চোখ বুজে পড়ে রইলেন। বিংহ্যামটনে আরেকটি বিরতি নেয়ার পর বললেন, ‘এবার আমি চালাই তুমি বিশ্রাম নাও।

আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি চালাতে পারবো।জোর দিয়ে বললো দ্বিতীয়।

তুমি দ্রুত গাড়ি ছোটালে আমার ভয় লাগে। তার থেকে আমিই চালাই।আপনি কথাটি না বলে পারলেন না। দ্বিতীয় অতএব আর কোনো আপত্তি না করে মাকে বললো, ‘তুমি প্যাসেঞ্জার সিটে যাও, আমি পিছে বসি।

গাড়ি টান দেয়ার সাথে সাথে আপনি লক্ষ্য করলেন পিছনের সিটে বসেই ছেলে ঘুমে অচেতন হয়ে গেছে। 

অ্যালমায়রার বাসায় পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল। পাহাড়ের ওপাশে সূর্য হেলে পড়লে বিকেলকে অনেকটা সন্ধ্যাই মনে হয়। আপনাদের একতলার ভাড়াটিয়া মেরির কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করে স্বাগত জানালো। মেরি তখন বাসায় ছিলেন না। ওর কুকুরটি বাসার ভেতর থেকেই আপনাদের আগমন টের পেয়ে সাড়া দিলো। লতা বললো, ‘মেরি বাসায় নেই কিন্তু ওর ঘরের এয়ারকন্ডিশন তো ছাড়াই আছে।

দ্বিতীয় বললো, ‘কুকুরের জন্যে এয়ারকন্ডিশন ছেড়ে রেখেছে।

নিজেকে তো বিল দিতে হয় না। তাই এই বাহাদুরি। বাড়ির মালিকের টাকায় এমন বাহাদুরি আমি আরো দেখেছি।আপনি দোতলার দরজা খুলতে খুলতে বললেন। 

ভাড়াটিয়াদের সাথে আপনার অভিজ্ঞতা অনেক। কুইন্সের যে বাড়িতে থাকেন, ওই বাড়ির দোতলার হিটার আলাদা, ফলে হিটের বিল আসে গ্যাস বিলের সাথে এবং সেটি ভাড়াটিয়ারাই দেন। একবার এক ভাড়াটিয়া বললেন যে তিনি ভাড়া কিছু বাড়িয়ে দেবেন, দোতলার গ্যাস বিলটা যেন আপনি দেন। আপনি রাজি হলেন। কিন্তু শীতের সময় তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের নিচে নামলেই তিনি আপনাকে ফোন দেয়া শুরু করলেন, আমি শীতে থাকতে পারছি না, তুমি হিট দিচ্ছো না কেন! কিন্তু পরের বছর আপনি বললেন, ‘তোমাকে অতিরিক্ত ভাড়া দিতে হবে না, তোমার গ্যাস বিল তুমিই দেবে।এবং যথারীতি শীতকালে এবার লক্ষ্য করলেন তিনি একেবারেই হিট ছাড়ছেন না। একদিন বরফ পড়ছে বাইরে, কিন্তু তার হিটার অফ দেখে আপনি ফোন করে জানতে চাইলেন, ‘কি ব্যাপার তোমার হিটার ঠিক আছে তো, আমি উপরে এসে দেখে যাবো?’ তিনি বললেন, ‘হিটারে কোনো অসুবিধা হয়নি, আমি প্রতিদিন দৌড়াতে যাই, এবছর ম্যারাথনে যাবো, তাই আমার হিটের দরকার হয় না।অতএব মেরি যে কুকুরের জন্যে এয়ারকন্ডিশন ছেড়ে রাখবেন সেটাই স্বাভাবিক। তবে মেরিকে দিয়ে আপনার সুবিধা হলো, বাড়ির সামনে পিছনের ঘাস সে নিয়মিত কাটে, গারবেজ ফেলে, আপনার অবর্তমানে দোতলা এই বাড়িটি তিনি দেখাশোনা করেন যার জন্যে তাকে অতিরিক্ত কোনো পয়সা দিতে হয় না। তিনি নিজের বাড়ির মতো করেই এই বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ করেন। 

এখানে এলে আপনার সবচেবড় যে সুবিধাটি হয় তাহলো খুব ভোরে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে, তড়িঘড়ি বিছানা ছেড়ে হাঁটতে বেরোন। সুনসান নিরবতা বাংলাদেশে আপনার জন্ম গ্রামের কথা মনে করিয়ে দেয়। সন্ধ্যা হতেই ঝিঁঝি পোকার ডাকে মানুষ ঘুমাতে চলে যায়। 

সকালে ঘুম থেকে উঠে বাইরের লনে দাঁড়াতেই একতলার বারান্দা থেকে মেরি স্বাগত জানালেন, ‘হ্যালো, জহির! কেমন আছেন?’

হাই, মেরি। গুড মর্নিং।আপনি হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললেন, ‘আপনি তো জানেন এখানে এলে আমি সব সময় ভালো থাকি।

কথা বলতে বলতে ডানপাশের কাঁটাতারের গেট খুলে পিছনের লনে ঢুকলেন। একপাশে ঘেরাও দিয়ে সব্জি বাগান করেছেন মেরি।বাহ্, আপনার বাগানে তো দেখছি অনেক টমেটো! বেগুন, শশা, এতো দেখছি অনেক কিছু!’

মেরি বাইরে না এসে বাড়ির পিছনের দিকের জানালা দিয়ে বললেন, ‘আপনার যখন যেটা ইচ্ছা তুলে খেতে পারেন।

আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।আপনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।

পিছনের লনে যেখানে সেখানে কুকুরের হাগু শুকিয়ে আছে। আপনি সেটা দেখছেন পরখ করে মেরি বললেন, ‘ঘাস কাটার আগে আমি ডক পু পরিষ্কার করে দেবো। জানেন তো আমার কুকুরটা পিছনের লনে খেলা করে। একটু সাবধানে হাঁটবেন।

আপনি মেরিকেবাইবলে রাস্তা দিয়ে পূবদিকে হেঁটে গেলেন, উদ্দেশ্য এল্ডরিজ পার্ক। এই বাড়ি থেকে আধা মাইলের মধ্যে একটি বিশাল পার্ক। মাঝখানে একটি দীঘি। চারপাশ ঘিরে অসংখ্য গাছপালা। দীঘিতে নানা রকমের মাছ। তাছাড়া দর্শনার্থীদের জন্যে নামমাত্র ভাড়ায় নৌকা চড়ার ব্যবস্থা আছে। নানা জাতের হাঁস পানিতে কেলি করে বেড়ায় সারাক্ষণ। দীঘির উত্তর পাড়ে ক্যারোসেলসহ শিশুদের বিনোদনের হরেকরকম সরঞ্জাম। সব কিছু মিলে সপরিবারে বেড়াতে আসার মতো জায়গা বটে। তবে আপনি এখানে এলে এই দীঘির চারদিক দিয়ে সকালে হাঁটেন। পানি ছোঁয়া শীতল বাতাস আর পাখিদের কাকলির সাথে সূর্যের তরুণ রশ্মি সারাদিনের জন্যে মনটাকে ফুরফুরে করে তোলে। 

পার্কে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি সেরে বাসায় ফিরে সামনের লনে দাঁড়াতেই লক্ষ্য করলেন যে রাস্তার ওপাশের বাসায় নতুন মানুষ; বারান্দায় স্বামীস্ত্রী বসা। আপনি একটু এগিয়ে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করেন কতদিন আগে তারা এই বাড়ি কিনেছেন। তারা বলেন, মাস ছয়েক। বাড়ির আগের মালিকের কথা জিজ্ঞেস করলে ভদ্রমহিলা বলেন, তারা যতদূর জেনেছেন তিনি প্যান্ডেমিকের শুরুর দিকে মারা গেছেন। এই বাড়ি কিনেছেন মৃত ভদ্রমহিলার ছেলের কাছ থেকে। ওই ভদ্রমহিলার নামও ছিলো মেরি। আপনার সাথে ভালো বন্ধুত্ব ছিলো তার। আপনি এখানে এলেই মেরির জন্যে কিছু না কিছু কিনে আনতেন। কিন্তু এই তো জীবন, এই আছে এই নেই। তবে মেরির বেশ বয়স হয়েছিলো। প্যান্ডেমিকের আগের সামারে যখন এসেছিলেন তখন তার শরীর বেশ খারাপ, ঘর থেকে খুব একটা বের হতেন না। বাড়ির নতুন মালিক জানালেন, ‘আমরা যতদূর শুনেছি মৃত্যুর আগেই তাকে রচেস্টারে স্থানান্তর করা হয়েছিলো।

বিশেষ একপ্রকার মনোবেদনা নিয়ে বাসায় ঢুকতেই দেখেন দ্বিতীয় তার মায়ের মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। আপনি হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোর মায়ের কি হয়েছে!’

আম্মুর গায়ে জ্বর।বাটিতে রাখা পানির ভেতরে কিচেন টাওয়াল ভিজিয়ে দুই হাত দিয়ে পানি নিংড়াতে নিংড়াতে দ্বিতীয় জবাব দেয়। আপনাদের কিচেনে ছোটো ছোটো তাওয়াল আছে, তার একটি সে উপস্থিত ক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছে।

বলিস কি! কখন জ্বর এলো!’ 

রাতেই জ্বর জ্বর লাগছিলো, এখন আর পারছি না।লতা ধরা গলায় নিজেই উত্তর দিলেন।

ডাক্তারের কাছে নিতে হবে।আপনি তড়িঘড়ি বলে উঠলেন।

তাড়াহুড়ো করো না। আগে নাস্তা করে নাও। তারপর আস্তে ধীরে গেলে চলবে।লতা আবারও দুর্বল স্বরে বললেন।

আমি বরং বাইরে থেকে নাস্তা নিয়ে আসি। কি আনবো বলো। তোমার জন্যে স্যুপ আনলে ভালো হবে। কিন্তু তার আগে তোমার জ্বর মাপা দরকার। কিন্তু এখানে থার্মোমিটারও তো নেই।আপনি স্ত্রীর কপালে হাত দিয়ে জ্বরের ঘোর অনুভব করার চেষ্টা করলেন। আর মুখে বললেন, ‘না, জ্বর তেমন বেশি নয়।’ 

নাস্তা খেয়ে হাসপাতালে যাবার আগে আপনার স্ত্রী বললেন, ‘হাসপাতালে গেলে তো সারা দিন কেটে যাবে। এখানে বরং কোনো ক্লিনিক খুঁজে বের করো।

দ্বিতীয় তার ফোনে ইন্টারনেট ঘেটে জানালো যে মাইল তিনেকের ভেতরে একটি ক্লিনিক আছে।ঠিক রাইট এইডের উল্টো দিকে। চিনতে পারছো?’ আপনাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলো সে।

এই বাসায় আসার সময় গ্যাস স্টেশনের উল্টো দিকে যে রাইট এইড?’

ওটা তো দক্ষিণ পাশে। আর ক্লিনিক হচ্ছে গ্যাস স্টেশনের পুব পাশে।ম্যাপ দেখে বললো দ্বিতীয়।

তৎক্ষণাৎ স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। এবং সেখানে গিয়ে অল্প সময়ের ভেতরে একজন ডাক্তারেরও দেখা মিললো। তিনি ইউরিন পরীক্ষা থ্রোট কালচার করতে দিলেন। ইউরিন পরীক্ষার ফলাফল প্রায় সাথে সাথেই পাওয়া গেল। কিন্তু থ্রোট কালচারের রেজাল্ট দুই দিনের ভেতর আসবে বলে ডাক্তার জানালেন। তিনি ইউরিন ইনফেকশনের কথা বলে ওষুধ লিখে দিলেন। বললেন, ‘প্রচুর পানি খেতে হবে।

আপনি ডাক্তারকে অ্যালমায়রায় আপনাদের অবস্থানের কারণ খুলে বলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘নিউইয়র্ক শহরে আপনাদের ক্লিনিকের কোনো শাখা নেই?’

তিনি বললেন, ‘শহরেই তো আমাদের কত শাখা। এখানে এই শাখাটি পরীক্ষামূলকভাবে মাস তিনেক আগে খোলা হয়েছে।

তিনি কুইন্সে যে শাখার ঠিকানা দিলেন সেটি আপনাদের বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে নয়। ডাক্তার বললেন, ‘ওখান থেকেই থ্রোট কালচারের রেজাল্ট নিতে পারবেন। আর যে ওষুধ দিয়েছি ঠিকমতো খেলে সপ্তাহখানেকের ভেতরই রোগি ভালো হয়ে যাবেন।

আপনাদের আর অ্যালমায়রায় থাকা হলো না। পরদিনই শহরের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেলেন। পাহাড়ে উঠে হরিণ দেখা, মার্ক টোয়েনের লেখার ঘর ঘুরে দেখা, সকালে দূর গ্রামে গিয়ে নাস্তা করা, পঁচিশ মাইল উত্তরে অটকিন গ্লেন ঝর্ণার কাছাকাছি যাওয়া এইসব পরিকল্পনার কোনোটাই বাস্তবায়ন হলো না। যদিও করোনার সময় এগুলো খোলা আছে কিনা সেটাও জানা হয়নি। তথাপি লতার শরীরের কথা ভেবে আপনাদের ভ্রমণ সংক্ষিপ্ত হয়ে গেল। কুইন্সে ফিরে পরদিন লতাকে নিয়ে ডাক্তারের দেয়া ঠিকানা মতো ক্লিনিকে গিয়ে থ্রোট কালচারের রেজাল্ট পেলেন। আগের ওষুধের সাথে ডাক্তার আরেকটি ওষুধ লিখে দিলেন। বললেন, ‘এক সপ্তাহের ভেতর

Related Posts