জোর করে উপকার করা ||মনজুর কাদের

নরকের কীট থেকে

বিদ্বেষ শেখা হয়

ভাগ হয়ে হয়ে সব

মানুষেরা একা হয়


এক ছাত্রকে ক্লাসে দেরী করে আসার কারণ জিজ্ঞেস করলে ছাত্রটি উত্তর দিল,

স্যার, আসার পথে অশীতিপর এক বৃদ্ধাকে রাস্তা পার করাতে গিয়ে দেরী হয়ে গেলো।

তাই বলে এতো দেরী?

স্যার, বুড়ি তো রাস্তা পার হতেই চাচ্ছিল না!!


একদল তৌহিদী জনতা জোর করে একজন বৃদ্ধের চুল দাড়ি কেটে দিল। বৃদ্ধ প্রথমে উচ্চস্বরে চিৎকার করে পরে প্রাণপণ শক্তি প্রয়োগ করে বাধা দিয়েও মোল্লাদের এই অপকর্ম থেকে বিরত রাখতে পারেনি। অতঃপর নিরুপায় শীর্ণকায় শক্তিহীন বৃদ্ধ অবিরতভাবে আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে চলেছে আর তাগড়া জোয়ান মৌলভীরা সোৎসাহে তাকে জাপটে ধরে চুল দাড়ি কেটে দিয়ে তবে ছেড়েছে। তৌহিদী জনতার এই নাপিতের দল সাংবাদিক মানবাধিকার কর্মীদের জেরার মুখে বলেছেন, তারা নাকি স্বতঃ প্রণোদিত হয়ে বৃদ্ধের উপকারের জন্যই এমনটা করেছেন।


আরেকদল তৌহিদী নাপিত মোল্লা এক উদাসীন বাউলের চুল দাড়ি কাটতে এলে বাউল হাতের বাদ্যযন্ত্র দিয়ে এলোপাথারি পিটুনি শুরু করলে অবস্থা বেগতিক দেখে মোল্লার দল পথচারীদের আল্লার দোহাই দিয়ে তাদের একাজে সহযোগিতার অনুরোধ করে। কিন্তু পথচারীরা উল্টা বাউলের পক্ষ নিয়ে রুখে দাঁড়ালে তারা জাহান্নামের বদ দোয়া দিতে দিতে স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।


প্রসংগে আরেক মেম্বার সাহেবের গল্প মনে পড়লো। গ্রামের মেম্বার সাহেব নতুন লুঙ্গি ফতুয়া পরে মেয়ের বাড়ি চলছেন। পাশ দিয়ে রিক্সা যাওয়ার সময় চাকার হুকের সাথে লেগে লুঙ্গি খানিক ছিঁড়ে গেল। আর অমনিই তুলকালাম।

আমার নতুন লুঙ্গির দাম দিতে হবে।

হুজুর আমি গরিব মানুষ। তাছাড়া দোষ কিন্তু আমার না, আপনিই রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছিলেন।

লোক জটলা বেড়ে গেল। গ্রামবাসী এই সিদ্ধান্ত দিলো যে, মেম্বার সাহেবের লুঙ্গির দাম পুরো পাঁচ টাকা রিক্সাওয়ালাকে দিতে হবে।

কী আর করা! রিক্সাওয়ালা তার সারাদিনের উপার্জন গুনে গুনে পাঁচ টাকা মেম্বার সাহেবের হাতে তুলে দিলো। ঘটনা মিটমাট।

ঘটনা কিন্তু মিটমাট হলো না। রিক্সাওয়ালার যু্ক্তি, সে যখন লুঙ্গির পুরো দাম পরিশোধ করেছে, এখন লুঙ্গির মালিক তো সে। তাকে লুঙ্গি দিয়ে তবে মেম্বার সাহেবকে স্থান ত্যাগ করতে হবে।

আবার গুঞ্জন উঠলো। সবাই বললো, কথার যুক্তি আছে।

কী আর করা! মেম্বার সাহেব রিক্সাওয়ালাকে পাঁচ টাকা ফেরত দিতে চাইলো।

রিক্সাওয়ালা বেঁকে বসলো। ক্রয়সূত্রে লুঙ্গির মালিক এখন আমি। আমি তো পাঁচ টাকায় লুঙ্গি বেচবো না। আমার লুঙ্গির দাম এখন হাজার টাকা।


একটি ঘটনা বলি। নব্বই সালের ঘটনা। সুমন সরাসরি অফিসার হয়ে ব্যাংকের একটি শাখায় যোগদান করলো। শাখার পুরনো কর্মচারীরা গ্রাহক সেবায় তেমন মনোযোগী না হওয়ায় তরুণ অফিসার সুমন সাগ্রহে প্রায় সব গ্রাহকের সুযোগ সুবিধার প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখে। খোঁজ খবর নেয়।

একদিন সুমন দেখলো এক বৃদ্ধ একপাশের একটি টুলে পা উঠিয়ে বসে আছে তো আছেই। সুমন নিজ থেকে জিজ্ঞেস করলো,

আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?

বৃদ্ধ উত্তেজিত হয়ে বললো, —সেই সকাল থেকে চেক দিয়ে বসে আছি, আমার টাকা দিচ্ছে না!

সুমন ক্যাশ অফিসারের কাছ থেকে জানতে পারলো, তিনি কুড়ি লক্ষ টাকার চেক দিয়েছেন। শাখায় এতো টাকা নেই। মেইন অফিসে রিকুইজিশন দেয়া হয়েছে। ওনাকে অপেক্ষা করতে হবে।

সুমন কৌতুহলবশত লেজার চেক করে দেখলো, বৃদ্ধের একাউন্টে চুয়াল্লিশ লক্ষ টাকা। জানা গেল, তার চৌদ্দ ছেলে। সবাই লন্ডন থাকে। এক ছেলে দেশে এসেছে বিয়ে করতে। তাই টাকা তোলা প্রয়োজন। স্বাভাবিকভাবেই সুমন একটু পর পর বৃদ্ধের খোঁজ খবর নেয়। পানি, চা কিছু খাবে কী না জিজ্ঞেস করে। বৃদ্ধ আড় নয়নে শুধু তাকায়।

দুপুরের পর টাকা এলো। বৃদ্ধের ছেলে শাখায় এলো বাবাকে নিয়ে যেতে। যাবার সময় বৃদ্ধ সুমনকে দেখিয়ে তার ছেলেকে বললো,

এই ছেলেটার সম্পর্কে খুব সাবধান। ওর নজর আচরণ খুবই সন্দেহজনক।

সুমন খুবই মর্মাহত হলো, মনের কষ্ট ম্যানেজারকে জানালে তিনি গম্ভীর হয়ে বললেন,

কেউ কোন সাহায্য না চাইলে কখনো আগ বাড়িয়ে বাড়তি সাহায্য করতে যেও না।


দেখুন কথায় কথা বাড়ে। ক্রোধে ক্রোধ বাড়ে। যুক্তির পিঠে যুক্তিও বাড়ে।

লোকজন হাসাহাসি করে বলাবলি করছে, নিউইয়র্কে ডিমের দাম বেড়ে গেছে।

ঢাকায় যখন ডিমের হালি আশি টাকা তখনও লোকজন ব্যাগ ভর্তি করে ডিম নিয়ে আদালতে ঢুকেছে। পুলিশ নিরাপত্তা কর্মী সবাই দেখে মুখ টিপে হেসেছে। কী ঘটতে যাচ্ছে বুঝেছে। এরপরও বিনা বাধায় পুলিশ, উকিল বিচারকের সামনেই অজস্র ধারায় হাতকড়া লাগানো অসহায় বন্দীদের মাথায় অনর্গলভাবে ডিম মারা হয়েছে। অবস্থা এমন হয়েছে, কিছু ডিম লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে কোনো কোনো বিচারকের মাথাও স্পর্শ করেছে। ডিম ছাড়াও স্যান্ডেল, জুতা, ইস্টকও ছোঁড়া হয়েছে। পান্না নামের একজন সাংবাদিককে আদালতে তোলা হলে, বিচারকের সামনে আইনজীবীরা একজোট হয়ে আদালতের উপস্থিত সাংবাদিকদের বেদম প্রহার করেছে। এসময় বিচারক কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে খাস কামরায় চলে গেছেন। আদালতে আদালতের বাইরে এরকম হাজারো মবায়োজনের কথা নাই বা বললাম। কারণ কথায় কথা বাড়ে।

নিউইয়র্কে . ইউনুসের বিশাল সফরসঙ্গী নিয়ে কম রগড় হয়নি। ডিম ছোঁড়া নিয়েও চায়ের আড্ডায় কম ঝড় ওঠেনি। কেউ কেউ এমনও বলাবলি করছে, যে হারে শোধপ্রতিশোধের হুতাশন লেলিহান হচ্ছে, তাতে আগামীতে শুধু ডিম নয়, পলিথিনের ব্যাগে মলমুত্রও নিক্ষেপ হতে পারে!!

দেশে প্রবাসে জেদাজেদী, ক্রোধ, হিংসা, প্রতিহিংসা যে উন্মত্ত রূপ ধারণ করছে তাতে আগুন সহজে নিভবে বলে কেউ মনে করে না। কারণ দেশে এখন সভ্যতার চর্চার বদলে ক্রোধ আর অসভ্যতার চর্চা জনপ্রিয়তা হু হু করে বাড়ছে।

মুসলিম সংস্কৃতিতেও দলে দলে দ্বন্দ্ব বিভেদ বাড়ছে। আগে সহনশীলতাসহাবস্থানের অস্তিত্ব ছিলো। এখন প্রায় নেইই। যেটুক আছে সেটুকুও বিলীন হচ্ছে।

বেশ কয়েক বছর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কাদিয়ানি অপবাদে একটি শিশুর লাশ কবর থেকে তুলে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিলো। কয়দিন আগে ফরিদপুরে একটি কবর থেকে এক প্রবীণের লাশ তুলে পুড়িয়ে দেয়া হলো। তৌহিদী জনতা দল বেঁধে পরিকল্পনা করে মাজার ভাঙা শুরু করেছে।

দেশে শত শত ইসলামী স্কলারের আবির্ভাব হয়েছে এরা মাহফিলের নামে উদ্ভট উদ্ভট ধারণা প্রবর্তন করে চলেছে এবং একে অপরকে কাফের ঘোষণা করছে। এতে মানুষ দলে দলে বিভক্ত হয়ে উন্মাদ হয়ে উঠছে।

একদল বলছে চুল গোঁফ মুড়িয়ে শুধু দাড়ি রাখতে হবে। আরেকদল বলছে কাঁধ বরাবর সুন্নতি চুল রাখতে হবে। একদল বলছে একমুঠ পরিমাণ দাড়ি রাখতে হবে, আরেকদল বলছে, দাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। যত লম্বা হবেততো ফজিলত। শুধু চুল দাড়ির উদাহরণ। এরকম হাজার বিষয় নিয়ে হাজারো মতবিরোধ ইসলামী স্কলারগণ প্রতিদিন ছড়াচ্ছে আর লোকজন দলে দলে বিভক্ত হয়ে ফ্যানাটিক হয়ে পড়ছে।

অবস্থা এতোটাই ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করছে যে, নিজে জান্নাতে যাবে কী না সে জন্য কেউ বিচলিত নয় বরং জোর করে কিভাবে অন্যকে জান্নাতে দাখিল নিশ্চিত করা যায় সে বিষয়ে যেন সবাই বিচলিত।

অবস্থা চলতে থাকলে সেদিন বেশী দূরে নয় যেদিন, একদল জোর করে অন্যদলের চুলগোঁফ কামিয়ে দেবে আর অন্য দল এই দলের লম্বা দাড়ি কেটে এক মুঠ সাইজে নিয়ে আসবে।

কারণ, ধর্মীয় ফ্যানাটিজমের একটাই চরিত্র। তাহলো, নিজের মতামত অন্যের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া। আর কেউ না চাইলেও জোর করে তার উপকার(!) করতে যাওয়া।


Related Posts