রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে দেশের নিয়ন্ত্রণ নেই ||মফিজুল হোসাইন
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে নাটকীয়তার শেষ নেই, যারা গত এক বছর ধরে খেলছিল, তারাই এখনো এদিক সেদিক করে নিজেদের স্বার্থই দেখছে, আঠারো কোটি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির কোনো আশা দেখা যাচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও চালকের ভূমিকায়, তারা বার্মা এ্যাক্ট নিয়ে ব্যস্ত, ভারত বহুবার ডঃ ইউনূস সরকারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করে এখন হাল ছেড়ে দিয়ে বলছে একটি নির্বাচিত সরকার এলেই তারা একসাথে কাজ করতে পারে, পাকিস্তান বাংলাদেশে একটি অবস্থান তৈরি করতে এখনো সক্রিয় এবং সে কাজে তারা এখন তুরস্ককে ব্যবহার করতে চাইছে। চীন বরাবরের মত অর্থনৈতিক চাবিকাঠি ব্যবহার করে তাদের অবস্থান ধরে রাখতে চাইছে। ডঃ ইউনূস সম্ভবত আর ক্ষমতায় থাকতে চাইছেন না, কিন্তু মার্কিনিরা এখনো তার বিকল্প ঠিক করতে পারছে না। আওয়ামী লীগ সোস্যাল মিডিয়ায় হুমকি ধামকি দিলেও বাস্তবে কোন অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি। যদিও ২ অক্টোবর সুইডেন, ডেনমার্ক ও নরওয়ের রাস্ট্রদূতগণ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরীর সাথে দেখা করেছেন। বিএনপি ডাকসু/জাকসু নির্বাচনে ভরাডুবির পর কিছুটা ব্যাকফুটে চলে গেলেও ফিরে আসার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তারেক রহমানের মিডিয়া ক্যাম্পেইন তারই উদাহরণ। জামাতের বাস্তবে কতটুকু জনসমর্থন আছে তা এখনো স্পষ্ট না হলেও তারা ক্ষমতায় যেতে ভীষণ তৎপর এবং সে ক্ষেত্রে পাকিস্তান—মার্কিন যৌথ প্রকল্প একটা অঘটন ঘটিয়ে দিলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না। জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্ররা নেতৃত্ব ও পরিকল্পনার অভাবে প্রায় হারিয়ে যাবার পথে।
নির্বাচনঃ বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলগুলো অনেকদিন থেকেই একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন দাবি করে আসছিল, কিন্তু ডঃ ইউনূস সরকার বা তাদের কিছু কিছু উপদেষ্টা ৩/৪/৫ বছর পর্যন্ত, কারো কারো মতে ১০ বছর ক্ষমতায় থাকবেন, আর সংস্কার সংস্কার করে নির্বাচনকে অনিশ্চয়তায় ফেলে দেয়। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রীয় বাহিনী ব্যবহার করে দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্বও বাঁধিয়ে দেয়া হয়। দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক অগ্রগতি, কর্মসংস্থান, সংস্কারে ধীরগতিতে তীব্র সমালোচনার পর ডঃ ইউনূস সম্ভবত বুঝতে পারেন তার পক্ষে দীর্ঘদিন ক্ষমতা ধরে রাখা সম্ভব নয়, অনেক গড়িমসির পর ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্যতে মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি জ্যাকবসন সহ পশ্চিমা কূটনীতিকরা দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। ট্রেসি জ্যাকবসন নাকি দু’বার লন্ডনে গিয়েছিলেন একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর লক্ষ্যে। ওদিকে ডঃ ইউনূস জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে তিনটি বড় রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে একাধিকবার বৈঠক করে ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু দু’দিন আগে, সংবিধান সংশোধন কমিটির সভাপতি ডঃ আলী রিয়াজ জাতীয় নির্বাচনের আগে বা একই সময়ে জুলাই অভ্যুত্থানের সনদের ওপর গণভোটের আয়োজনের ব্যাপারে প্রস্তাব দিলে সব দল নাকি সম্মতি দেয়। ৭ অক্টোবর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে তারা গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একই দিনে চায়। এখন সরকার গণভোট বা জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কি খেলা খেলে তা দেখতে দেশবাসীকে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
আওয়ামী লীগঃ স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দলটি পথ হারিয়ে এখনো বাঁকা পথেই হাঁটছে, যে চালক দলকে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে, তাকে সঠিক পথ দেখিয়ে দেবার সাহস কারো নেই। দৈনিক মানবজমিন খবর ছেপেছে যে আমেরিকা ও বৃটেন নাকি মাইনাস শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ পুনর্বাসন করে দেবার প্রস্তাব দিয়েছে, কিন্তু হাসিনা তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। যদিও মানবজমিন তার সূত্র উল্লেখ করেনি। যদি খবরটি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের উচিত হবে পশ্চিমাদের রেজিম চেঞ্জের ইতিহাসটি জানা। তারা আওয়মী লীগের অন্য কাউকে সহ্য করবে কিন্তু শেখ হাসিনাকে কখনোই ক্ষমতায় ফিরতে দেবে না। শোনা গিয়েছিল একটি স্বচ্ছ নেতৃত্বের আওয়ামী লীগ আসবে এবং সাবের হোসেন চৌধুরী তার নেতা হবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে রকম কিছু দেখা যাচ্ছে না, সম্ভবত বেঈমান বা আরেক মোস্তাক হওয়ার ভয়ে সাবের হোসেন চৌধুরী রাজি হচ্ছেন না। ৬ অক্টোবর তিনটি ইউরোপীয়ান দেশের রাষ্ট্রদূত আরেকবার চেষ্টা করতেই হয়ত তার সাথে দেখা করেছেন।
বিএনপিঃ ডাকসু/জাকসু নির্বাচনে বিএনপি বড় একটা হোঁচট খেয়েছে। ধারণা করা গিয়েছিল জাতীয় নির্বাচনেও বিএনপির জয়ের সম্ভাবনা নেই, কিন্তু জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে ডঃ ইউনূসের মধ্যস্থতায় জামাত ও এনসিপির একটা সমঝোতা হওয়ায় আবার তারা আলোচনায় এসেছে। তবে সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মিডিয়া ক্যাম্পেইন। তিনি ১৭ বছর পর সরাসরি মিডিয়ায় কথা বললেন, তিনি একই সাথে বিবিসি এবং ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। বিবিসির সাক্ষাৎকারে তিনি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন, যা তাকে ক্ষমতায় যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারে। (১) পররাষ্ট্র নীতি: বিবিসি প্রশ্ন করে, তিনি ক্ষমতায় গেলে তার পররাষ্ট্র নীতি কি হবে, তিনি পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে তার নীতি হবে দেশ ও জনগণের স্বার্থ, কিন্তু মার্কিনীরা তো আমাদের স্বার্থ দেখবে না, তারা তাদের বার্মা এ্যাক্টের বাস্তবায়ন চাইবে, তাহলে তারেক রহমান ক্ষমতায় গেলে কি পার্বত্য অঞ্চলে মার্কিন উপস্থিতি বন্ধ করে দেবেন? (২) ভারত নীতি নিয়ে বলেছেন তিনি পানির ন্যায্য হিসসা চান এবং সীমান্ত হত্যা সহ্য করবেন না, এ দু’টি উত্তরই ভারতকে রাগান্বিত করতে যথেষ্ট। (৩) আওয়ামী লীগের প্রতিটি গুম, হত্যা ও টর্চারের বিচার করবেন, অর্থাৎ আওয়ামী লীগকে কোনো প্রকার ছাড় দিতে রাজি নন।
জামাতে ইসলামঃ বর্তমান দুনিয়ায় অনেক অঘটনই ঘটতে পারে, তেমনি একটি বাংলাদেশের জামাতে ইসলাম। ডাকসু নির্বাচনে জামাত জিতবে কেউ কোনদিন কল্পনা করতে না পারলেও তাই হয়েছে। এখন পাকিস্তান—আমেরিকার প্রেম খুব তুঙ্গে, তারেক রহমান যদি তাদের আনুকূল্য দিতে রাজি না হন, বিকল্প হিসাবে জামাতের সরকার হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
আমেরিকার বার্মা এ্যাক্টঃ ২০২১ সালের ৫ অক্টোবর মার্কিন কংগ্রেসে বার্মা এ্যাক্ট পাশ হয়। কাগজপত্রে এ আইনের লক্ষ্য বার্মা বা মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে সরিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও কয়েকজন বিশ্লেষকের মতে এর সাথে বাংলাদেশও সম্পৃক্ত। সে কারণেই ২০২৪ সালে শেখ হাসিনাকে সরানো হয় এবং ইউনূস সরকারের সহযোগিতায় মানবিক করিডোর নামে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম বন্দরে মার্কিন বাহিনী প্রবেশাধিকার পায়। প্রথমে প্রথম মার্কিন গণমাধ্যম থেকে ধারণা দেয়া হয় চীনের সাথে আমেরিকান একটি সামরিক সংঘাত অনিবার্য, কিন্তু এখন মনে করা হয় সামরিক নয়, একটি বাণিজ্যিক স্বার্থের জন্য মায়ানমারের রাখাইন অঞ্চল এবং বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলটি তাদের প্রয়োজন। এই অঞ্চলে মূল্যবান খনিজ পাওয়া যেতে পারে, যা তাদের হাই—টেক এবং সামরিক সরঞ্জাম তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। মূল্যবান এই খনিজ, যা ‘রেয়ার আর্থ’ নামে পরিচিত, পাওয়ার জন্য আমেরিকাকে চীনের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। বিশ্বের ৯০% রেয়ার আর্থ চীনে উৎপাদিত হয়। আমেরিকা চীনের বিরুদ্ধে শুল্ক যুদ্ধ শুরু করলে চীন ‘রেয়ার আর্থ’ বন্ধ করে দেয়, উপায় না পেয়ে আমেরিকা পিছু হটে। এখন তারা মায়ানমার এবং বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তানের বেলুচ প্রদেশে এই ‘রেয়ার আর্থ’ সন্ধান করছে।
ভারতঃ বাংলাদেশ নিয়ে ভারত ভীষণ অস্বস্তিতে আছে, কোন কিছুতেই ডঃ ইউনূস সরকারকে বাগে আনতে পারছে না। আবার আমেরিকার পদচারণায় শক্ত কোনো ব্যবস্থা নিতেও পারছে না। পাকিস্তানের দু’জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবার পূর্ব সীমান্ত দিয়ে আক্রমণের ঘোষণায় তারা তাদের পূর্ব সীমান্তে সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে এবং ভারতীয় সেনাপ্রধান কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম সেনা সদরে সব রকম প্রস্তুতি নেবার নির্দেশ দিয়ে গেছেন।
তুরস্কঃ তুরস্কের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভাল থাকলেও বর্তমান সময়ের মত এত ভাল কোনো কালেই ছিল না। তুরস্ক বাংলাদেশকে ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র দেয়ার পাশাপাশি অস্ত্র কারখানা করতেও নাকি প্রস্তাব দিয়েছে। এত আগ্রহের মূল কারণ পাকিস্তান। পাকিস্তান তাদের চিরশত্রু ভারতের পূর্বাঞ্চলে, অর্থাৎ বাংলাদেশে একটি সামরিক উপস্থিতি রাখতে চায়, কিন্তু ভারতের চোখ রাঙানি বা ডঃ ইউনূসের পররাষ্ট্রনীতির জন্যই হোক, বাংলাদেশ রাজি হচ্ছিল না। আবার পাকিস্তান তুরস্কের বন্ধুত্ব খুবই গভীর এবং অনেক পুরানো। গত মে মাসে ভারত—পাকিস্তান যুদ্ধে তুরস্ক পাকিস্তানকে শুধু সমর্থনই করেনি, সরাসরি ড্রোন সহ সামরিক সরঞ্জামও পাঠিয়েছে। তাছাড়া ৫০এর দশকে পাকিস্তান—তুরস্ক—ইরান মিলে ‘সেন্টো’ নাম দিয়ে একটি সামরিক জোটও গঠন করেছিল। সম্ভবত তুরস্ক পাকিস্তানের কাছ থেকে পারমাণবিক প্রযুক্তি নিতে চায়।
দেশের জনগণ বা রাজনৈতিক দলগুলো যাই ভাবুক, নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নেই। যদি পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে কিছু হয়, তাহলে ডঃ ইউনূস ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন।
নিউইয়র্ক
অক্টোবর ০৭, ২০২৫