জুলাই ঘোষণাপত্র ও বাহাত্তরের সংবিধানের অবমূল্যায়ন || আনিস আহমেদ
জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন ও অনুমোদন এবং সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার যে দাবি উঠছে এবং ঘোষণাপত্রের যে পাঠ গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস তুলে ধরেন, তার বেশ কিছু ধারায় স্বাধীনতার মূল ঘোষণাপত্রের কিছু উল্লেখযোগ্য অংশের অস্বীকৃতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রথম দিকে জুলাই ঘোষণাপত্রের প্রতি সম্মতি জানায়নি। প্রথমে বিএনপি, ১২ দলীয় জোট, ১১ দলীয় জোট, বিজেপি, এলডিপিসহ কয়েকটি দল চেয়েছিল সাংবিধানিক সংস্কার হবে পরের সংসদে। বিএনপি চেয়েছিল, গণভোট হবে নির্বাচিত সংসদে সংস্কার অনুমোদনের পর। তবে এখন ক্রমশ ঘটনাচক্রে বিএনপি ও সমমনা দলগুলি তাদের সুর পাল্টাচ্ছে। সমালোচকরা মনে করছেন যে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে সম্ভাব্য সাধারণ নির্বাচন দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ড. ইউনুস, তারই প্রেক্ষাপটে বিএনপি তার সুর পাল্টেছে এবং বলছে যে এ বিষয়ে নির্বাচনের দিনই গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। এ নিয়ে অবশ্য জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি’র মতপার্থক্য রয়েছে। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ অন্তত সাতটি দল চায়, সাংবিধানিক আদেশে নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদের সব সংস্কার কার্যকর করা হোক।
বস্তুত জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ ও বাস্তবায়ন সম্পর্কে আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম তথ্য পাচ্ছি। জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের আগস্ট মাসেই এই ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নে বিলম্বের জন্য সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। তাদের মনে এ রকম আশংকা কাজ করছে যে নির্বাচনের দিন জুলাই সনদ নিয়ে গণভোট হলে, সেই গণভোটে জুলাই সনদের বিপক্ষেই ভোট পড়তে পারে বিপুল সংখ্যায়। কারণ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ কোনো বিশেষ দলের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ও হতাশ থাকলেই যে তারা মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের স্বাধীনতা বিরোধী কোনো ঘোষণা সহজেই মেনে নেবে এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। ২৮টি ধারা বিশিষ্ট এই জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে গণভোট অনুষ্ঠানটির যৌক্তিক প্রয়োগও সম্ভব নয়। একজন ভোটদাতা যে ২৮টি ধারার সব কয়টি ধারার সঙ্গে সহমত হবেন তাতো নয়, তাহলে পক্ষে কিংবা বিপক্ষে ভোট প্রদানের যৌক্তিক কোন উপায় কি আছে? সাধারণত গণভোটে সোজা—সাপ্টাভাবে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর ‘হঁ্যা’ কিংবা ‘না’ ভোট নেয়া হয়। কিন্তু যেখানে ২৮টি ধারা রয়েছে এবং তার সব কয়টির ব্যাপারে সহমত হবার সুযোগ কম, সেখানে গণভোট অনুষ্ঠানের বাস্তবতা একেবারেই নেই বলে অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন। অতএব জুলাই অভ্যুত্থানের সনদপত্রের ওপর গণভোট অনুষ্ঠানের কোনো রকম যৌক্তিকতা নেই। সে ক্ষেত্রে একমাত্র নির্বাচিত সরকার সংসদে এই ঘোষণাপত্রের প্রতিটি ধারা বিশ্লেষণ করে তা ধারা অনুযায়ী অনুমোদন কিংবা প্রত্যাখ্যান করতে পারেন।
অবশ্য এই পদ্ধতিগত ত্রুটি ছাড়াও সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে জুলাই ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক লংঘন হয়ে উঠছে কী না। গত বছর ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জুলাই গণ—অভ্যুত্থানকে বিপ্লব আখ্যা দিয়ে ঘোষণাপত্র পাঠের সিদ্ধান্ত নেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা। ছাত্রদের পক্ষ থেকে তখন জানিয়ে দেওয়া হয়, ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে বাহাত্তরের সংবিধানকে কবর দেবেন তারা। বাহাত্তরের সংবিধানেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এবং সেই ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্রের আলোকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আদর্শে সেই সংবিধান রচিত হয়। সংবিধানে বৈধ উপায়ে কিছু সংশোধনী আনা হয়, তবে সংবিধানকে কখনোই পরিহার করা হয়নি। তাছাড়া বাংলাদেশে বেশ কয়েকবার গণ—অভ্যুত্থান ঘটেছে কিন্তু গণ—অভ্যুত্থানের পর ঘোষণাপত্র উত্থাপনের ইতিহাস নেই। অনেকেই বলছেন যে ২০২৪ সালের জুলাই—আগস্টের সেই আন্দোলন ও অভ্যুত্থানকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু তাই বলে জুলাই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে, বাহাত্তরের সংবিধানকে বাতিল করার কোন যুক্তি নেই। কেবল মাত্র যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ভূ—লুন্ঠিত করতে চায়, তারাই কেবল বাহাত্তরের সংবিধানের ‘কবর রচনার’ কথা বলতে পারে।
গত ৫ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. ইউনুস যে জুলাই ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করেন তার তিন ও চার নম্বর ধারায় মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সরকারের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে এটিকে একটি দলীয় প্রচারণায় পরিণত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়. ‘যেহেতু স্বাধীন বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নপদ্ধতি, এর কাঠামোগত দুর্বলতা ও অপপ্রয়োগের ফলে স্বাধীনতা—পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধের জন—আকাক্সক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছিল এবং গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা ক্ষুণ্ণ করেছিল; এবং যেহেতু স্বাধীনতা—পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার স্বাধীনতার মূলমন্ত্র গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিপরীতে বাকশালের নামে সাংবিধানিকভাবে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করে এবং মত প্রকাশ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ করে, যার প্রতিক্রিয়ায় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর দেশে সিপাহি—জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং পরবর্তী সময়ে একদলীয় বাকশাল পদ্ধতির পরিবর্তে বহুদলীয় গণতন্ত্র, মত প্রকাশ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুনঃপ্রবর্তনের পথ সুগম হয়’। এই ধারাগুলির সঙ্গে ‘সেহেতু বাংলাদেশের জনগণ জুলাই গণ—অভ্যুত্থানের সকল শহীদদের জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা করে শহীদদের পরিবার, আহত যোদ্ধা এবং আন্দোলনকারী ছাত্রজনতাকে প্রয়োজনীয় সকল আইনি সুরক্ষা দেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে’, এর কোন সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায় না। স্বাধীন বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নপদ্ধতি, এর কাঠামোগত দুর্বলতা ও অপপ্রয়োগের সঙ্গে জুলাই আন্দোলনের যৌক্তিকতাকে কিভাবে বিচার করা যাবে। বাহাত্তরের সংবিধানের কাঠামোগত দুর্বলতার কথা বলে সেই সংবিধানের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। সেই সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের জন—আকাঙ্খার কথা অবশ্যই উল্লেখ করা হয়েছে।
এ সম্পর্কে তাঁর প্রতিক্রিয়ায় ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান তাঁর ফেইসবুক পাতায় লেখেন, ‘এই ঘোষণাপত্রে তুলে ধরা ইতিহাসের বেশির ভাগ অংশ—একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ নিয়ে বর্ণনা অত্যন্ত পক্ষপাতদুষ্ট ও একতরফা। যাঁরা আওয়ামী লীগকে ঘৃণা করেন, এতে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করা হয়েছে বলে মনে হয়েছে..।’ তাছাড়া ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার মধ্য দিয়ে যে সামরিক শাসন জারির প্রক্রিয়া শুরু হয় তাকে এই ঘোষণাপত্রে গণতন্ত্র বিরোধী বলে উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি সেই নির্মম হত্যাকান্ডের কোনো উল্লেখ নেই সেখানে। অতএব সামগ্রিক বিবেচনায় জুলাই ঘোষণাপত্রে বহু জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধূলিস্মাৎ করার অভিপ্রায়ে বাহাত্তরের সংবিধানের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।