নিউইয়র্কে মন ভরিয়ে দিল সুরের ধারার শ্যামা

বাঙালী প্রতিবেদনঃ ধূসর সান্ধ্য আলোর মঞ্চের পিছনে কণ্ঠশিল্পীরা বসে আছেন। মাঝখানে মঞ্চ আলো করে একালের রবীন্দ্রসংগীতের পদ্মশ্রী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা একটু উঁচু বেদিতে। কিছুক্ষণ নীরব। তারপর জ্বলে উঠল আলো। হলুদ কস্টু্যম পরে, সুদর্শন রাজপুত্র প্রবেশ করলেন। মঞ্চের অন্যদিক থেকে তার বন্ধু। গান ধরলেন, তুমি ইন্দ্রমনির হার, এনেছ সুবর্ণ দ্বীপ থেকে। উত্তর দিলেন বজ্রসেন, না না না বন্ধু, আমি অনেক করেছি বেচাকেনা, অনেক হয়েছে লেনাদেনা। এতো হাটে বিকোবার নয় হার। কণ্ঠে দিব আমি তারই, যাকে বিনামূল্যে দিতে পারি। তবু আছে সে কোথায়। আজো তারে হয় নাই চেনা। বন্ধু জানায়, জানো নাকি, পিছনে তোমার রয়েছে রাজার চর। বজ্রসেন বলেন, জানি জানি, তাইতো আমি চলেছি দেশান্তর। এইসময় নগর কোটাল প্রবেশ করে বজ্রসেনকে থামিয়ে দিয়ে বলে, থামো থামো কোথায় চলেছ পালায়ে। সে কোন্ গোপন দায়ে। বজ্রসেন উত্তর দেন, আমি বণিক, চলেছি আপন ব্যবসায়ে। নৃত্যের তালে ও গানের ছন্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিণত জীবনের (১৯৩৩) গ্রন্থনা করা গীতি নৃত্যনাট্য এইভাবে চলতে শুরু করে।
তার লেখা দুই সহ¯্রাধিক গানের মধ্য থেকে থিমের সাথে মিলিয়ে সেগুলো রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থনা করেন গীতি নৃত্যনাট্যে। চন্ডালিকা, চিত্রাঙ্গদা, মায়ার খেলা, তাসের দেশ, শ্যামা বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তিনি ভারতীয় নাট্যশাস্ত্রকে ব্যবহার করে এর নাটকীয়তা আনেন এবং দক্ষিণ ভারতীয় নৃত্যকলার শিল্প রূপ প্রয়োগ করেন। সেই সাথে প্রতিটি নৃত্যনাট্যের আখ্যান তৈরি করেন। এইসব নৃত্যনাট্যের সব চরিত্রই গানের ছন্দে ও নাচের তালে প্রবাহিত হয়।
শ্যামা নৃত্যনাট্যে বজ্রসেনরূপী রুদ্রাভ নিয়োগী, উত্তীয়রূপী শুভজিৎ দাস, কোটালরূপী কোহল দাস এবং শ্যামা চরিত্রে আংকাশ্রী পুততুন্ড পুরো নৃত্যনাট্যের প্রাণ হলেও পাঁচ সখী তাদের দৃষ্টিনন্দন নাচের সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে গতিশীল করে রেখেছিলেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।
এই নৃত্যনাট্যের কাহিনীর উৎস বৌদ্ধ মহাবস্তু। রবীন্দ্রনাথ তার কথা ও কাহিনী কাব্যে প্রতিশোধ নামে একটি কবিতা গ্রন্থিত করেন। সেই প্রতিশোধ কবিতাই শ্যামার ভিত্তি। শ্যামা রাজদরবারের নর্তকী। সে এক বিদেশী ব্যবসায়ী যুবকের প্রেমে আবিষ্ট হলে তাকে চুরির অপরাধে নগর কোটাল বা প্রহরীরা আটক করে এবং মৃত্যুদন্ড দেয়। তাকে বাঁচাতে গিয়ে বিশ্রস্ত হয় শ্যামা এবং নিজের স্বর্ণালংকার সহ জীবন উৎসর্গ করারও প্রস্তাব দেয়। এদিকে শ্যামা আরেকটি জটিলতা তৈরি করে রেখেছে উত্তীয়কে নিয়ে। এতদিন উত্তীয় তার প্রেম নিয়ে কিছুই বলেনি শ্যামাকে। হঠাৎ উত্তীয় এসে ত্রিভুজ ভালোবাসায় জটিলতা তৈরি করে। উত্তীয়ের চেয়ে বজ্রসেন বেশি পৌরুষদীপ্ত হওয়ায় তার অব্যক্ত প্রথম প্রেমকে ফিরিয়ে দেয়। বজ্রসেনের প্রতি রাজন্যবর্গের দৃষ্টি পড়ে। তারা তাকে জব্দ করতে চায়। উত্তীয় প্রেমের জন্য নিজেই ধরা দিতে চায়। শ্যামার অন্তর্দ্বন্দ্ব, ব্যক্তি জীবনে শাসকদের নিবর্তন আর বজ্রসেনের মনোবল, নতকীর্ হলেও তার প্রেমে নিবেদিত থাকার এবং শ্যামাকে পাওয়ার সংকল্পে অটুট শক্তি এই নৃত্যনাট্যটিকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টান টান উত্তেজনায় বেঁধে রাখে। মঞ্চে পাঁচ সখী এবং চার চরিত্র তাদের নাচের সমন্বয়ে দৃশ্যমান সৌন্দর্য তৈরি করলেও চরিত্রগুলোর শারীরী ভাষা, মুখের প্রকাশভঙ্গি, চোখের ব্যবহার এবং হাতের মুদ্রা তাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও অভিঘাতকে বাঙ্ময় করে তোলে। সেই বাঙ্ময়তা মঞ্চের সামনে বসা নিমগ্ন দর্শকদের আপ্লুত করে। তারা ছিল নিশ্চুপ অর্থাৎ রুদ্ধশ্বাস।
রবীন্দ্রনাথ তার নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা, চন্ডালিকা ও মায়ার খেলায় নারীদের যেভাবে মহীয়সী করে তুলেছেন, সেখানে শুধু মহত্বে নয়, প্রেমের পরাকাষ্ঠা নির্মাণেও নারীকে প্রেমিকা সত্ত্বার রিয়েলিটি থেকে বিচ্যুত করতে চাননি। শ্যামার প্রেমে বজ্রসেন আর উত্তীয় তাই পাপ—পুণ্যের বিচার করেনি। তারা তাকে মহীয়সী নারী এবং প্রেমিকা নারী হিসাবেই দেখেছে সে রাজনর্তকী (অন্য অর্থে গণিকা) হলেও। অবশ্য এই ক্ষেত্রে উত্তীয় যতটা কোমল হৃদয়সম্পন্ন, বজ্রসেন ততটা নয় বলেই শ্যামাকে আংটি দিয়েও বিচ্ছেদের কথা ভাবতে পেরেছে।
রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রবীন্দ্রনাথ এখানে সুর ও নৃত্যের সমন্বয়ে গেঁথেছেন প্রেমের আকুলতা, অপরাধবোধের ক্রন্দন, ত্যাগের নৈঃশব্দ এবং মুক্তির উচ্চারণ। এই নৃত্যনাট্যে প্রেমের পরিণয় নয় বরং মুক্ত আত্মার আত্মপ্রকাশই চূড়ান্ত সুর। শ্যামার চরিত্র মনে করিয়ে দেয় আমাদের অনেক ভালোবাসার মধ্যেও হয়ত লুকিয়ে থাকে নিজস্ব চাওয়া, প্রাপ্তির তৃষ্ণা। কিন্তু উত্তীয় দেখায় ভালোবাসা মানে কেবল পাওয়া নয়, বরং এমন কিছু দেয়া যা অন্যকে মুক্তি দেয়। তিনি মনে করেন, ভালোবাসা তখনই পূর্ণ হয়, যখন তা নিজেকে ছাড়িয়ে অন্যের জন্য ত্যাগে (স্যাক্রিফাইস) রূপ নেয়। রবীন্দ্রনাথ শ্যামার মধ্য দিয়ে জানান দিয়েছেন, মুক্তি মানে কেবল গ্রহণ বা অর্জন নয়, স্যাক্রিফাইসেই আসল মুক্তি। শ্যামা নৃত্যনাট্য প্রেম, অপরাধ, আত্মদান ও ক্ষমার সুনিপুণ রূপক। মূল কথা হলো, প্রেম কীভাবে একজন মানুষকে মুক্ত করতে পারে সংকীর্ণতা থেকে, সেই সত্যকেও (কঠিন হলেও) তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ শ্যামার আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে।
নৃত্যনাট্যের শেষে বজ্রসেন মরণলোক থেকে নতুন প্রাণ নিয়ে ফিরে আসার আকুতি জানায় শ্যামাকে। শ্যামা ফিরে এসে ক্ষমা চায়। কিন্তু বজ্রসেন তাকে চলে যেতে বলে। বজ্রসেনকে প্রণাম করে শ্যামা চলে যায়। তখন বজ্রসেন স্বগতোক্তির মত করে গায় ক্ষমিতে পারিলাম না যে/ ক্ষম হে মম দীনতা../ প্রিয়ারে নিতে পারিনি বুকে, প্রেমেরে আমি হেনেছি/ পাপীরে দিতে শাস্তি শুধু পাপেরে ডেকে এনেছি..। অভীক দেবের ভরাট কণ্ঠের করুণ সুরে শেষ হয় নৃত্যনাট্যটি দর্শক—শ্রোতাদের হৃদয় উন্মাতাল করে।
এই ক্লাসিক নৃত্যনাট্যটি মঞ্চে একটানা বিরতিহীনভাবে কোনো হোঁচট ছাড়াই পরিবেশন করে সুরের ধারা। সাউন্ড ট্র্যাকে মিউজিক চলছে, মঞ্চের পিছনে বসে শিল্পীরা সঠিক সময়ে কিউ ধরে গান ধরছেন যেখানে ধরার, ছাড়ছেন যেখানে ছাড়ার, নৃত্যশিল্পীরা যখন যার কিউ সেই অনুসারে মঞ্চে প্রবেশ করছেন, আবার প্রস্থান নিচ্ছেন। মঞ্চে হিসাব—নিকাশ করে যেখানে যার অবস্থান করার কথা, করছেন, কখনো কেউ ঠোঁট মেলাচ্ছেনÑ সব মিলিয়ে একটি অনবদ্য পরিবেশনা প্রত্যক্ষ করল নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, পেনসিলভেনিয়া, কানেকটিকাট, ম্যাসাচুসেটস থেকে আসা বিদগ্ধ দর্শকরা। শ্যামা চরিত্রে অভিনয় করা আংকাশ্রী পুতপুন্ডুই ছিলেন এই নৃত্যনাট্যের নৃত্য নির্দেশক। আর সংগীত পরিচালনায় ছিলেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। সংগীতে কণ্ঠ দেন শ্যামার গানে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা নিজে, বজ্রসেনের গানে অভীক দেব, উত্তীয়র গানে সারওয়ার হারুন, কোটালের গানে তাজুল ইমাম, আর বন্ধুর গানে দেবাশীষ বসু। সখীদের গানে কণ্ঠ দেন বিদিশা দেওয়ানজী, এলমা কায়সার, সুপর্ণা বসু, সাবরিনা খুরশিদ তনিমা, আদ্রিনা জামিলী, রাজিয়া আহমেদ রুমু, তনুশ্রী নন্দী, মহাশ্বেতা মুখোপাধ্যায়, চিরশ্রী লাহিড়ী, নুজহাত ফারিহা খান, মাহবুবা রহমান মিলু, সুরাইয়া দীপা, মধুমিতা সরকার, শাহনাজ রহমান সুমি, জারা চৌধুরী, শুভানন রাজিত।
এই নৃত্যনাট্য পরিবেশনাকালে একবারের জন্যও শব্দ বিভ্রাট ঘটেনি। শব্দ নিয়ন্ত্রণে ছিলেন সৌগত সরকার হিল্লোল। পরিমিত আলোকসম্পাত ছিল মনোযোগ রক্ষাকারী। আলোক নিয়ন্ত্রণে ছিলেন বাবর খাদেমী।
শুরুতেই লন্ডন থেকে আসা উর্মি মাঝহার সংক্ষিপ্ত সূচনা দিয়ে আমন্ত্রণ জানান শিল্পীদের। এই পর্যায়ে সুরের ধারার ৬ প্রাক্তন শিক্ষার্থী, যারা এখন দেশের বাইরে বসবাস করেন, পরিবেশন করেন দুটি করে রবীন্দ্রসংগীত। এই শিল্পীরা হলেন সাবরিনা খুরশিদ তনিমা (কত যে তুমি মনোহর এবং নয়ন মেলে দেখি আমার), বিদিশা দেওয়ানজী (মাঝে মাঝে তব দেখা পাই এবং আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা), শারদ প্রতীতি (জগতের আনন্দ যজ্ঞে এবং তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়), অভীক দেব (মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে এবং গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে), শুভানন রাজিত (তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা এবং একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ) ও আদ্রিনা জামিলী (আমি তোমারই মাটির কন্যা এবং কোথা হতে বাজে প্রেম বেদনা রে)।
যন্ত্রানুসংগে তবলায় ছিলেন পিনুসেন দাস এবং কীবোর্ডে সৌরভ দাস।
মাঝে সুরের ধারার প্রকল্প ‘মিউজিক ফর ডেভেলপমেন্ট’ বিষয়ে ছোট ছোট তিনটি তথ্যচিত্র দেখানো হয়। এই তথ্যচিত্রে বাংলাদেশে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে সংগীত চর্চা বিস্তৃত করে তাদের সুকুমার বৃত্তিকে বিকশিত করার উদ্যোগের কথা বলা হয়।
শুরুতে সঞ্চালক উর্মি মাঝহার জানান, সুরের ধারা কেবল গান শেখায় না, সুরের ধারা শিল্পী তৈরি করে।
জ্যামাইকা পারফর্মিং আর্ট সেন্টার বা জেপ্যাকের থিয়েটারে কোনো আসন খালি ছিল না। বিরতিহীন অনুষ্ঠানটি দর্শনীর বিনিময়ে উপভোগ করে দর্শকরা বুক ভরা আনন্দ নিয়ে ফিরে গেছেন এই কথা বলতে বলতে যে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা অদ্বিতীয়। এই অনুষ্ঠানটির কথা দর্শকরা অনেকদিন স্মৃতিতে সংরক্ষণ করবেন।
এই অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধান করেন বিদিশা দেওয়ানজী, শাহরিয়ার নবী, এলমা কায়সার ও নামিয়া নুজহাত চৌধুরী। আর সার্বিক পরিচালনায় ছিলেন সুরের ধারার প্রধান রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা।
এটি ছিল সুরের ধারার নিবেদন আর আয়োজক ডায়াসপোরা ইউএসএ ইনক এবং এর প্রধান ডা. প্রতাপ দাস।