আমেরিকার প্রেস ফ্রিডমের গায়ে হাত

লিবারেল আমেরিকা কনজারভেটিভ আমেরিকায় রূপান্তর হচ্ছে দ্রুত। এই রূপান্তরের প্রক্রিয়া রিপাবলিকানরা অনেক আগে থেকে শুরু করেছেন। কিন্তু তা ছিল খুব ধীরে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েই রক্ষণশীল আমেরিকা কেমন হতে পারে তার চিহ্নতুলে ধরেন নানা কট্টরপন্থী মন্তব্যের মধ্য দিয়ে। নির্বাচিত হয়ে তিনি এথনিক ক্লিনজিংএর মত অমানবিক কাজ শুরু করেন ইমিগ্রান্ট এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে। এই আধাওয়েলফেয়ার দেশে দরিদ্র মানুষদের জন্য যেসব কর্মসূচী চালু ছিল তার ওপরও হাত দিতে শুরু করেন। অবশ্য রিপাবলিকান ডেমোক্রেটিক পার্টির মূল পার্থক্য কেবল অর্থনীতি বিষয়ে যে দুই মেরুতে অবস্থান তা নয়, উদার আমেরিকাকে রক্ষণশীলতার দিকে নিয়ে যাওয়াও এই দুই বৃহৎ রাজনৈতিক দলের বড় এজেন্ডা। চিন্তাই করা যায় না ১৯৭২ সালে গর্ভপাত বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট রো ভার্সাস ওয়েড মামলার যে রায় দিয়েছিল এই একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে তা ছিল আমেরিকায় নারীদের বা ব্যাপক অর্থে নাগরিকদের ব্যক্তি অধিকার বিষয়ে সাংবিধানিক রক্ষা কবচের বিরুদ্ধে।

আব্রাহাম লিংকন রিপাবলিকান হওয়া সত্ত্বেও দাসপ্রথা বিলুপ্ত করার জন্য লড়াই করেছেন। ১৯৬৮ সালে ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসন সিভিল রাইটস এ্যাক্ট পাশ করার পরে মনে করা হয়েছিল আমেরিকা লিবারেল দেশ হিসাবে তার পতাকা সবসময় ওপরে তুলে ধরবে। কিন্তু ইরানে রক্ষণশীলদের উত্থান, আফগানিস্তানে সোভিয়েট বিরোধিতার জন্য তালিবানের উত্থান বিকাশের ক্ষেত্র তৈরি করার পর পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে মুসলিম মৌলবাদ বিস্তৃত হওয়ায়, এবং ভারতে হিন্দু মৌলবাদ ক্ষমতায় যাওয়ায়, সেইসাথে ইয়োরোপের অনেক দেশে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটদের উত্থানে নতুন শতাব্দী যে পৃথিবীকে রক্ষণশীলতার ধারায় ঠেলে দিচ্ছে তা বোঝাই যাচ্ছিল। এমন এক পরিস্থিতিতে আমেরিকা যেন এক লাফে সকলকে টপকে যায়।

যে আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রতিবছর পৃথিবীর তাবৎ দেশের মানবাধিকার লংঘন বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে সকলের ওপর একধরনের মাতব্বরী করে, সেই আমেরিকার মানবাধিকার লংঘনের বিষয়টি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার মত কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। এই মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ তুলে ধরে যেসব দেশে সবচেয়ে মানবাধিকার লংঘন হয় বলে তারা উল্লেখ করে, সেসব দেশে তারা খবরদারি শুরু করে।

আমেরিকার সংবিধানের অনেক বিষয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সকল দেশের মানুষের কাছে যা শিক্ষণীয় তাহলো ফাস্টর্ এমেন্ডমেন্ট। যেখানে স্পষ্ট ভাষায় প্রতিটি মানুষের বাক, ধর্মচর্চা, লেখা পড়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অনেক ক্ষেত্রেই সংবিধানকে খুব গুরুত্বের স্থানে বসাতে যে রাজি নন তা তার আচরণেই বোঝা যায়। এবার তার প্রতিরক্ষা সেক্রেটারি গত শুক্রবার ঘোষণা করলেন, ডিফেন্স ডিপার্টমেন্ট যদি অনুমোদন না দেয়, তাহলে কোনো সংবাদপত্র বা সংবাদমাধ্যম কোনো ক্লাসিফাইড বা আনক্লাসিফাইড তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করতে পারবে না। যদি করে তাহলে সেইসব সংবাদ মাধ্যমের প্রেস ক্রেডেনশিয়াল বাতিল করে দেবে।

ওয়াশিংটন পোস্ট শুক্রবার এই খবরটি দিয়ে বলছে, কয়েক মাস যাবতই পেন্টাগন রিপোর্টারদের সংবাদ পাওয়া এবং সংবাদের জন্য বা তথ্য যাচাই করতে বাধার সম্মুখীন করছিল। এমন কি পেন্টাগনের সকল কমকর্তা কর্মচারীর প্রতি কঠোর নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল যে কোনো তথ্য যেন লিক না হয়। এমন কি প্রতিরক্ষা সেক্রেটারি ঐদিনই তারএক্স লেখেন, নিরাপত্তার কারণে পেন্টাগনের হলওয়েতে হাঁটাচলার জন্য সাংবাদিকদের নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির নাইট ফাস্টর্ এমেন্ডমেন্ট ইন্সটিটিউটের ডেপুটি ডিরেক্টর কেটি ফালো বলেন, আমেরিকার ফ্রি স্পিচ প্রেস ফ্রিডমের ওপর এটা বড় আঘাত। ন্যাশনাল প্রেসক্লাবের প্রেসিডেন্ট মাইক ব্যালসামোও এই নির্দেশনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এমন কি পেন্টাগন থেকে নিউইয়র্ক টাইমস, এনবিসি নিউজ এনপিআর এর অফিসও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পেন্টাগনে তাদের নিউজ ব্রিফিং রুমে সপ্তাহে যে দুদিন ব্রিফিং হতো তাও বন্ধ করা হয়েছে সম্প্রতি।

কথা ছিল ডিফেন্স ডিপার্টমেন্টের এই নতুন পলিসির প্রতি সমর্থন জানিয়ে মঙ্গলবার সংবাদ মাধ্যমকে স্বাক্ষর করতে হবে। কিন্তু ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউইয়র্ক টাইমস, এসোসিয়েটেড প্রেস, দ্য আটলান্টিক, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, রয়টার্স, ওয়াশিংটন টাইমস, সিএনএনসহ অন্যান্য অনেক সংবাদপত্র, নিউজ এজেন্সি নিউজ টিভি স্বাক্ষর করতে তাদের অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ওয়াশিংটন পোস্টের এক্সিকিউটিভ এডিটর ম্যাট মারে বলেন, আমরা মনে করি নতুন এই নিয়ম ফাস্টর্ এমেন্ডমেন্ট অর্থাৎ ফ্রিডম অব প্রেসের গ্যারান্টির বিপক্ষের অবস্থান। ইউএস মিলিটারি বছরে আমেরিকার ট্যাক্সদাতাদের দেয়া প্রায় ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। তাদের অভ্যন্তরীণ খবর জানার অধিকার আমেরিকার জনগণের আছে।বলেছে নিউইয়র্ক টাইমসের ওয়াশিংটন ব্যুরোর প্রধান রিচার্ড স্টিভেনশন।

যখন কোনো সরকার সংবাদ মাধ্যমকে ভয় করে, তখন ধরে নিতে হবে সেই সরকারের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নেই, তাদের অনেক কিছু লুকানোর প্রবণতা। যে কারণে তারা সংবাদ মাধ্যমকে প্রথমত এড়িয়ে চলে। পরে তাদের নির্দিষ্ট এলাকায় নিষিদ্ধ করে। আমেরিকায় সংবাদ বন্ধ করার কোনো নজির নেই। তাই সংবাদ মাধ্যমের কলম বা কণ্ঠ রোধ করার চেষ্টা করে না সরকার। আমেরিকা গণতান্ত্রিক দেশ। গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শক্ত ভিত্তির ওপর গড়ে উঠেছে। কটাস, পটাস, স্কটাস অত্যন্ত ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ায় অনেক কিছুই এককভাবে করা অত্যন্ত দুরুহ। কিন্তু যখন সরকারের প্রায় সবগুলো স্তম্ভ এক দলের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে, তখন শুরু হয় বিপত্তি। রাজনীতির ভাষায় যাকে বলা হয়ব্রুট মেজোরিটি আজ আমেরিকায় সেই ব্রুট মেজোরিটির যুগ চলছে। আইনের কারণে কখনো কখনো চেকস এন্ড ব্যালেন্সেসের কিছুটা লক্ষণ দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে আইনও তার নিয়োগদাতার দিকে ঝুঁকে পড়ে। কারণ সেখানেও ভোটাভুটির ব্যাপার রয়েছে।

বাক স্বাধীনতার এই দেশে, প্রেস ফ্রিডমের এই দেশে বিশ্ববিখ্যাত সংবাদ মাধ্যমগুলোকে যখন নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতা শুরু হয়, তখন ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগাকুল হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আশার কথা, সংবাদমাধ্যম যেহেতু রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ, এবং অনেক সংবাদ মাধ্যমের ভিত্তি যেহেতু অনেক শক্ত, তাই হঠাৎ করে কেউ একজন যে তার ভিত্তি কাঁপিয়ে দেবে তা কি সম্ভব? নিউইয়র্ক টাইমস বিভিন্ন সময় প্রমাণ করেছে, তারা আমেরিকার যে কোনো সরকারের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। ওয়াশিংটন পোস্ট ওয়ারটারগেট কেলেংকারির প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছিল, নিউজউইক মনিকা লিউনিস্কিকে নিয়ে খবর ছেপে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনকে নড়বড়ে করেছিল। এমন উদাহরণ অনেক।

আমেরিকার সরকারের যেন বোধোদয় হয়। যেন তারা বাক স্বাধীনতা প্রেস ফ্রিডমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়। কারণ যে দেশে সংবাদ মাধ্যম যত শক্তিশালী, সেই দেশে সরকারও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আর এর জন্য সরকারকে লিবারেল হতে হবে। জনগণকে সর্বতো স্বাধীনতা দিতে হবে।

Related Posts