নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে যত অশান্তি || ড. জীবন বিশ্বাস

নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে সাম্প্রতিক ও ঐতিহাসিক বিতর্কগুলি বিভ্রান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছে এ বছর (২০২৫) ভেনেজুয়েলার বিরোধীদলীয় নেতা মারিয়া করিনা মাচাদোকে দেওয়া শান্তি পুরস্কারও। নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য যোগ্য ব্যক্তি নির্ধারণ এবং মনোনয়ন প্রক্রিয়ার প্রকৃতি নিয়েও বিশ্ববাসীর মধ্যে বিভ্রান্তি এ বছর আরও বেড়েছে। অনেক বিশ্বখ্যাত পলিটিক্যাল সাইন্টিস্ট ও রাজনৈতিক সমালোচক যুক্তি দেন যে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর একজন সোচ্চার প্রতিপক্ষ মাচাদোকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছে। হোয়াইট হাউজের যোগাযোগ পরিচালকও নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটিকে ‘শান্তির চেয়ে রাজনীতিকে’ অগ্রাধিকার দেওয়ার অভিযোগ করেছেন। বাংলাদেশের ড. মুহম্মদ ইউনুসকে ২০০৬ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্তির পরেই বাংলাদেশের শাসনক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সেই প্রায় ২০ বছর আগেই রাজনৈতিক দল গঠন করতে দেখা গেছে। তখন চরমভাবে ব্যর্থ হলেও তিনি ঠিকই ২০ বছর পর ক্ষমতার মসনদে বসেছেন প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে। কারা, কিভাবে এবং কেন ড. মুহম্মদ ইউনুসকে বাংলাদেশের ক্ষমতায় বসিয়েছে তা এখন আর কারো কাছে অজানা নয়। ভেনেজুয়েলার বিরোধীদলীয় নেতা এবারের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মারিয়া করিনা মাচাদোও পশ্চিমের স্বার্থ হাসিলে হয়তোবা ভেনেজুয়েলার ইউনুস হতে চলেছেন। নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্ক এবছর তাই আরও বেগবান হয়েছে। এসব প্রসঙ্গ নিয়েই আজকের উপসম্পাদকীয়।
বিবিসির মতো নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে মাচাদো ভেনেজুয়েলার বামধারার মাদুরো সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ট্রাম্পের সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন সময়ে। ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি নিজেই এই পুরস্কারের জন্য প্রচারণা চালিয়েছিলেন, দাবি করেছেন যে মাচাদো ফোন করে তাকেই এই পুরস্কার উৎসর্গ করেছেন। মাদুরো সরকারের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এবং মাদুরো শাসনের জোরপূর্বক অপসারণের প্রতি মাচাদোর সমর্থন এই পুরস্কারের ভিত্তি বলে বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন। অর্থাৎ নোবেল শান্তি পুরস্কার ঘিরে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য এবং ঘটনাবলী বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি এবছর আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
বিভ্রান্তির সাধারণ উৎস হচ্ছে বিজয়ী সম্পর্কে নোবেল কমিটি কর্তৃক অস্বচ্ছ যোগ্যতা ও অবদানের অজানা কারণসমূহের উল্লেখ। পুরস্কারটি প্রায়শই সুনির্দিষ্ট অর্জনের পরিবর্তে একধরনের আকাক্সক্ষার ফলপ্রসূ করার জন্য দেওয়া হয় বলে অনেকে মনে করেন। আবার যাদের পরবর্তী কর্মকান্ড পুরস্কারের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক বলে মনে হয়, তাদেরকেও দেয়া হয় বলে অনেকে মনে করেন। হেনরি কিসিঞ্জার এবং লে ড্যাক থু—কে যৌথভাবে ১৯৭৩ সালে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় হ্যানয় এবং কম্বোডিয়ায় বোমা হামলার সাথে সম্পর্কিত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে কিসিঞ্জারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল। থো এই বলে পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন যে প্রকৃত শান্তি অর্জিত হয়নি। মূলত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মায়ানমারে শান্তিপূর্ণ লড়াইয়ের জন্য ১৯৯১ সালে অং সান সুচি—কে নোবেল শান্তি পুরস্কারে সম্মানিত করা হলেও, পরে তিনি রোহিঙ্গা জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে তার নীরবতার জন্য সমালোচনার মুখোমুখি হন। বারাক ওবামা ২০০৯ সালে তার প্রথম মেয়াদের এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে এই পুরস্কারটি পান যা চরম সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল। আবি আহমেদকে ২০১৯ সালে এই পুরস্কার দেয়ার পর, ইরিত্রিয়ার সাথে শান্তি চুক্তিতে জয়লাভের এক বছর পর, ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী টাইগ্রে অঞ্চলে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন।
নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির গোপন নির্বাচন প্রক্রিয়া, যার মধ্যে মনোনীতদের নাম প্রকাশের ওপর ৫০ বছরের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, প্রায়শই কাদের প্রকৃত বিবেচনা করা হচ্ছে সে সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করে। উল্লেখযোগ্য ভুল থেকেও বিভ্রান্তি তৈরি হয়। মহাত্মা গান্ধীর কথা ধরা যাক। তিনি একাধিকবার মনোনীত হয়েছিলেন কিন্তু কখনও পুরস্কার পাননি, যদিও এই অন্যায়টি নিয়ে কমিটির অনেক সদস্য পরে অনুশোচনা করেছিলেন। লক্ষণীয় যে, নরওয়ের অসলোতে নরওয়েজিয়ান সংসদ কর্তৃক নিযুক্ত একটি কমিটি দ্বারা শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হয়, যখন অন্যান্য নোবেল পুরস্কার সুইডেনের স্টকহোমে বিভিন্ন সুইডিশ একাডেমি দ্বারা প্রদান করা হয়। নির্বাচন প্রক্রিয়ার এই পার্থক্য অতিরিক্ত বিভ্রান্তি তৈরি করে চলেছে যুগ যুগ ধরে।
নোবেল শান্তি পুরস্কার বরাবরই নৈতিক সাহসকে সম্মান দেওয়া এবং রাজনৈতিক ফলাফলকে প্রভাবিত করার মাঝখানে এক সূক্ষ¥ রশির ওপর দিয়ে গড়াগড়ি করে চলছে সেই প্রথম থেকে। জনমনে সবচেয়ে বড় বিভ্রান্তি আসে মনোনয়ন ও নির্বাচন প্রক্রিয়া ঘিরে। সবাই—ই মনোনয়ন দাখিল করতে পারে— এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। বাস্তবে শুধু জাতীয় সংসদ বা সরকারের সদস্য, নির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারপতি, পূর্বতন শান্তি পুরস্কারজয়ী, এবং নির্দিষ্ট শাখার বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক, এঁরাই শুধু মনোনয়ন দাখিল করতে পারেন। ২০২৫ সালে মোট ৩৩৮ প্রার্থী তালিকাভুক্ত হয়েছে যার মধ্যে ছিল ২৪৪ জন ব্যক্তি এবং ৯৪টি সংস্থা। কাজেই গণমাধ্যমে ভেসে বেড়ানো নামগুলোর সঙ্গে প্রকৃত আলোচনার ফারাক বিশাল।
নোবেল শান্তি কমিটি জানিয়েছে ২০২৫ সালে ভেনিজুয়েলায় গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় এবং নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ রূপান্তরের লক্ষ্যে মাচাদোর ভূমিকার স্বীকৃতি হিসেবে এ পুরস্কার দিয়েছে। প্রেক্ষাপটে আছে বিতর্কিত ২০২৪—এর নির্বাচন, প্রার্থিতা বাতিল, এবং আত্মগোপনে থেকেও ধারাবাহিক নাগরিক আন্দোলন। সমর্থকরা এটিকে স্বৈরতান্ত্রিক দমননীতির বিরুদ্ধে অহিংস প্রতিরোধের স্বীকৃতি বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তথ্য—উপাত্ত দিয়ে বলছেন, মাচাদো পশ্চিমের চাপ ও শক্তিপ্রয়োগমুখী অবস্থানকে সবসময়ই সমর্থন করে আসছেন যা ‘শান্তি’ শব্দটিকে বিতর্কিত করেছে তার পুরস্কার প্রাপ্তির আগে থেকেই।
বাংলাদেশ থেকে ভেনিজুয়েলা, এ পথ যেন একেবারে সরলরৈখিক বৈশ্বিক রাজনীতির কালিমালিপ্ত পথ। নোবেল কমিটি ২০০৬ সালে ড. মুহম্মদ ইউনূসকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করার কিছুদিন পরেই তিনি বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করে দারুণভাবে ব্যর্থ হন, জনগণ তাকে পশ্চিমের ক্রীড়নক হিসেবে সন্দেহ করতে থাকে এবং তাকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু শেখ হাসিনার পদত্যাগের প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট ড. মুহম্মদ ইউনূস অস্থির বাংলাদেশের অন্তর্বতীর্ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন। কাজেই দীর্ঘদিন ধরে বাতাসে ভেসে বেড়ানো ‘২০০৬ সালের নোবেলটি বাংলাদেশ অস্থির করার প্রকল্প বই আর কিছু নয়’— গুঞ্জন সত্যে পরিণত হয়। তাই বিশ্ববাসীর প্রশ্ন, বাংলাদেশের ২০০৬ সাল থেকে ২০২৪ সালের সেতু কি ২০২৫—এর ভেনিজুয়েলাতেও মিলবে? সম্ভাবনা আছে, তবে কিছুটা শর্তসাপেক্ষে। বাংলাদেশের রূপান্তর এসেছিল ছদ্মবেশীদের ষড়যন্ত্রে শেখ হাসিনার সরকারের পতনে। আর ভেনিজুয়েলায় পথ রুদ্ধ করে আছে পশ্চিমের চোখ—রাঙানির তথাকথিত নিরাপত্তা—যন্ত্র, সমান্তরাল প্রতিষ্ঠান ও আঞ্চলিক ভূ—রাজনীতি। জাতীয়করণকৃত জনসম্পদ, যেমন জ্বালানি এবং অন্যান্য আরও অনেক কিছুই মাদুরোর কারণে জনতারই মালিকানায় রয়েছে বলে মুনাফালোভী পশ্চিমের যত ক্ষোভ। সে ক্ষোভ ভেনেজুয়েলায় ‘গণতন্ত্র নেই’ বলে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনের ডাক দেয়, যার পুরোভাগে পায় মাচাদোর মত বিশ্বস্ত বন্ধুকে, বাংলাদেশে যেমন পেয়েছে ড. মুহম্মদ ইউনূসকে। বাংলাদেশে চট্টগ্রাম বন্দরসহ অনেক কিছুই এখন সেই পশ্চিম এবং মধ্যস্বত্বভোগীর দখলে যেতে বসেছে। ভেনেজুয়েলায় মাচাদো সে চেষ্টা করেই শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন, এই হিসেবের কোথাও কোনো গন্ডগোল নেই বলে ওয়াকেবহাল মহল মনে করে।
কাজেই ২০২৫—এর নোবেল শান্তি পুরস্কারটি মারিয়া করিনা মাচাদোকে দিয়ে নোবেল শান্তি কমিটি যে যথার্থ এবং সৎ কাজটি করেছেন তা নিশ্চিত করে বলার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে, নোবেল লরিয়েট মর্যাদা রূপান্তরের নামে ষড়যন্ত্রের মব—সংস্কৃতিকে উসকে দিয়ে ‘স্বৈরাচারী—গণতন্ত্র’— নামের নতুন সঞ্জীবনী—সুধার বিপণনে যেমন পারদর্শিতা দেখিয়েছে, ভেনিজুয়েলায় মাচাদো সে চেষ্টা করেই নোবেল জয় করেছেন। এখন তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর পালা। সেক্ষেত্রে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার নেতৃত্বের বাংলাদেশ সম্ভবত মাচাদোর রোল মডেল হিসেবেই কাজ করবে। নোবেল শান্তি পুরস্কার শান্তিকে আশ্রয় করে হয়তো একদিন এগিয়ে যাবে, সে দিন যত দূরেই থাক না কেন, আশা করতে কোনো দোষ নেই।