এক অলৌকিক নিরুদ্দেশ যাত্রা—২ || জসিম মল্লিক টরন্টো
সেদিন ছিল রাত। আমি ঘুরছি। এরকম হয় আমার। আমি একটু অন্যধারার মানুষ। আমি বুঝি, আমার সাথে কারো খুুব ভিতরে মিল খায় না। আমি সেটা কাউকে বুঝতে দেই না। নিজেকে আড়াল করার কৌশল আমি ভালো রপ্ত করেছি। বাঁচার জন্য আমাকে এসব শিখতে হয়েছে। নানা অঘটন আর যন্ত্রণাময় পৃথিবীতে নিজেকে আড়াল করা একটু কঠিন বৈকি। কেউ কেউ মনে করে আমি ’তার লোক; বস্তুত তা না। আমি সেকথা তাকে বুঝতে দেই না। যাকে আমি কাছের মনে করি সে থাকে গোপনে। আমি বলি না। ইচ্ছে করে না বলতে। ভালোবাসার একটা রূপগন্ধ আছে। টের পাওয়া যায়। আমার ভিতরে দুটো সত্ত্বা বাস করে। একটা একান্ত নিজস্ব আর একটা সাধারণ। দুটোর মধ্যে অহর্নিশ একটা লড়াই চলে এবং প্রথমটার কাছে দ্বিতীয়টা যথারীতি হেরে যায়।
আমি সেই রাতে ঘুরছি। একাকী। একাকী পথ চলার আনন্দ আমি উপভোগ করি। রাত তখন ন’টা। শীতের সন্ধ্যাকে মধ্য রাত মনে হয়। বাইরে একটা অদ্ভুত মায়াবী পরিবেশ। কোলাহলহীন রাস্তা দিয়ে আমি যাচ্ছি। নিরুদ্বিগ্ন আমি। আমার কোনো গন্তব্য নেই। গেলেই হয়। পথ হারানোতেও ভয় নেই। এক সময় ঠিকই আমি ফিরবো। ফিরতে হয়। বাইরে কী সুন্দর শুভ্রতা। পেলব মায়াবী রাত। আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে থোকা থোকা শিউলি ফুল। অঝোরে। পড়তে পড়তে স্তুপ হয়ে যাচ্ছে। আমার গাড়ির উইন্ডশিল্ড শুভ্রতায় আচ্ছাদিত হচ্ছে। আমি গাড়িটা পার্ক করে বাইরে বের হলাম। আমার কালো কোট ধীরে ধীরে ঢেকে যাচ্ছে শুভ্রতায়। নিজেকে মনে হচ্ছে একটা কফিনের মধ্যে আচ্ছাদিত হয়ে যাচ্ছি। আমার মা’কে যখন সাদা কাফনের কাপড়ে আচ্ছাদিত করা হয়েছিল সেই দৃশ্যও অনেকটা এরকমই হওয়ার কথা! আমি দেখিনি। আমি দু’হাত দিয়ে শিউলি ফুল ধরছি। ফুলেরা ভেঙে যাচ্ছে, গলে যাচ্ছে। আহা কী মোলায়েম! কটন ক্যান্ডি বা পেজা তুলোর মতো উড়ে উড়ে যাচ্ছে, ঝরে পড়ছে বরফ। প্রকৃতি ঢেকে গেছে কবরের নিরবতায়। যে কবরে আমার মা ঘুমিয়ে আছেন। একাকী! জানিনা মা কেমন আছেন! জানা যায় না।
বিকেল যখন ঘনিয়ে আসে তখন মাঠের ওধারে জড়ামরি গাছপালার ফাঁকে যে কী তুলকলাম একটা কান্ড ঘটে যায় রোজ তা কেউ তাকিয়েই দেখে না ভাল করে। আকাশ থেকে আলোর চাকাটা তখন নামতে থাকে আর সেই সময়ে কোথাও কিছু না হঠাৎ একটা ভুতুরে মেঘ এসে তিন—চার খন্ড হয়ে ভাসতে থাকে। আর গাছপালার কালচে রঙের ছায়া থেকে অশরীরীর মতো ভেসে উঠতে থাকে ঘোর কুয়াশার মতো, ধোঁয়ার মতো, প্রেতের মতো সব জিনিস। পশ্চিমের আকাশে তখন লাল সাদা কালো মেঘের তুলির টান। দিগন্ত দ্রুত তার আলোর গালিচা গুটিয়ে নিতে থাকে। প্রথমে দীর্ঘ ছায়া দীর্ঘতর হতে থাকে, আর অন্ধকার বুনে চলে কালো এক মাকড়সা।
প্রতিদিন এইভাবে দিন যায়, দিন আসে। জীবন থেকে এক একটা স্বর্ণালী মুহূর্ত খসে পড়ে। যখন আমি এইভাবে একা হয়ে যাই, ভীষণভাবে একাকী, ভাবি জীবন কত অকিঞ্চিতকর! মানুষ যে কেন তা বোঝেনা! মানুষের ধারণা কত কী আছে তার চারিদিকে! অহংকার, বন্ধুত্ব, প্রেম, আত্মীয়তা, নিরাপত্তা। আসলে কিছু কী আছে! কিছু কী থাকে জীবনে! আমি ইদানীং একটা নির্লিপ্ততার ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে গেছি। সময় আমাকে কেড়ে নিয়ে গেছে নিঃসীম নিঃসঙ্গতার পারাপারে। কোলাহল আমাকে আকৃষ্ট করে না। আমি কখনই কোলাহল প্রিয় ছিলাম না। মানুষের দঙ্গলে আমি হাঁফিয়ে উঠি। অস্বস্তিবোধ করি।
মানুষের ভাষা আমার বোধগম্য হয় না। আমার ভাষাও তারা বোঝে না। আমি নির্বাক হয়ে মানুষের কান্ডকারখানা দেখি। নিজেকে মাঝে মাঝে ভোম্বল ভোম্বল লাগে। সবকিছু দেখে শুনে হয় গৌতমবুদ্ধর মতো গৃহত্যাগী হয়ে যাই। মানুষের কোলাহলের চেয়ে নির্জন গুহায় গিয়ে থাকা অনেক ভাল। স্তব্ধতার কানে কানে আমি শুনতে পাই আমার নিজের অন্তরের আর্তনাদ। আমি আসলে নিজেকে বুঝিনা। কাউকে বোঝাতেও পারি না। কেউ আমাকে সঠিক বোঝে বলেও মনে হয় না। যাদের বোঝার কথা ছিল তারা বোঝেনি। আমাকে নিয়ে কখনও কথা হলে আমি অস্বস্তিতে পড়ি। প্রশংসা বা সমালোচনা কোনোটারই সঠিক উত্তর করতে পারি না। আমি কারো কাছে কিছু প্রত্যাশা করি না। চেনা মানুষরা সাধারণতঃ সমালোচনা করতে পছন্দ করে। তাদের ধারণা, ‘আরে এ তো আমাদের জসিম! লেখালেখি নাকি করে! কী লেখে কে জানে! ওর আবার কিসের সুখ দুঃখ!’ এইভাবেই চেনা মানুষেরা মূল্যায়ন করে। কিন্তু সেজন্য আমার কোনো অনুতাপ হয় না। আমি এই মূল্যায়ন নিয়ে চিন্তিত নই। বরং আমার প্রতি কম মনোযোগ আমার জন্য স্বস্তিদায়ক।
আমি জানি আমার মধ্যে ভীষণ রকম অসম্পূর্ণতা রয়েছে। আমি নিজেকে কখনোই গুছিয়ে প্রকাশ করতে পারিনি। কিভাবে নিজেকে তুলে ধরতে হয় সেই কৌশলটা আমার জানা নেই। আমি গুছিয়ে ভালোবাসতেও পারিনি। আমার মধ্যে যে এক ধরনের চাঞ্চল্য আছে তাই আমাকে কখনও স্থির হতে দেয়নি। আমি খুবই একজন ইমপারফেক্ট মানুষ। কোনো কিছুই আমি পরিকল্পনা করে করতে পারিনি। এই যে আমি একজন এলেবেলে টাইপ লেখক, সেই লেখাটাও আমি ঠিকঠাক মতো গুছিয়ে লিখলাম না। আসলে নিজেকে গুছিয়ে এক জায়গায় জড়ো করা যায় না। আমার ভিতরে সুরের যে একটা মায়াজাল ছিল কোথায় যেন একটা তার ছিঁড়ে গেছে। সেটা কিছুতেই আর জোড়া লাগতে চাইছে না।
যখন নির্জন ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হাঁটি তখন নিবিড় ঝিম ঝিম, অনুত্তেজক নৈঃশব্দ ঘিরে ধরে আমাকে। ঘিরে ধরে ভেজা মাটির গন্ধ। ঘিরে ধরে গাছপালা। মনে হয় এরাই আমার বন্ধু। মানুষেরা আমার কেউ না। প্রতিটি বৃক্ষ, কীটপতঙ্গ, তৃণভূমি, নদী, পশুপাখি সব আমার বন্ধু। মনে মনে ভাবি একদিন আমি শহরের বাস ঘুচিয়ে চলে যাব গাঁয়ে। গরুর গাড়ি, ডোবার গর্ত, পানিতে ভরভরন্ত, খানাখন্দ ভেঙে, কাদা ঘেঁটে হাঁটব, মাটি মাখব, ভাব করব পৃথিবীর সঙ্গে। আল পথ দিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে চলে যাবো। ক্ষেতগুলো ডুবে থাকবে পানিতে, চিনে জোক রক্ত চুষে নেবে, ক্রমে নিবিড় থেকে নিবিড়তর গাঁয়ের মধ্যে চলে যেতে যেতে দু’খানা চোখ রূপমুগ্ধ সম্মোহিত হয়ে মা’কে খুঁজে বেড়াবে।
যতটা দরকার ছিল ঠিক ততটা মায়ের পাশে থাকতে পারিনি। খুব কৈশোরে বরিশাল ছাড়া বাইরের জগত কিছুই জানতাম না। কিভাবে যে একদিন আমি বেরিয়ে পড়লাম পৃথিবীর বুকে! ওখানকার জল—হাওয়া—মাটি আমাকে কিছু বলতে চাইত। আমার বন্ধুর মতো ছিল সব। আমি গাছের সঙ্গে, পোকামাকড়ের সঙ্গে, কুকুর—বেড়াল—গরুর সঙ্গে, পাখির সঙ্গে কথা বলতাম। সবসময় যেন আনন্দ একটা নদীর মতো কুলকুল করে বয়ে যেত বুকের ভিতর দিয়ে। তখন খুব মনে হত, আমি কখনও একা নই। আমার সঙ্গে গাছপালা, পশুপাখি সবাই আছে। আর আছে আমার মা। এখন এতটা বয়সেও এক যুক্তিহীন বাচ্চা ছেলে আমাকে হাত ধরে কেবলই টানে। খুব টানে।
ওখানকার মাটির ভিতর দিয়ে একটা প্রাণের স্পন্দন আমার শরীরে উঠে আসত। বর্ষাকালে ভীষণ বাজ পড়ত, ঝড়—বাদল তো ছিলই। মাঠ ঘাট পানিতে টইটুম্বুর হয়ে যেতো। কিন্তু ভয় করত না। খোলা মাঠের মধ্যে, ঝড়—বাদলে, বজ্রপাতের মধ্যে খুব তুচ্ছ লাগত নিজেকে। মনে হত, এই তো এইটুকু আমি। আমি মরে গেলেও তো কিছু নয়। ওই বিরাট আকাশ, ভীষণ বৃষ্টি, মস্ত নীল আগুনের ঝলক এত ঘটনার মধ্যে মৃত্যু এমন কীই বা!
শুধু একটা রেলগাড়ির শব্দ পাওয়া যায়।
মা মারা যাওয়ার পর এক ধরনের মনোবৈকল্যৈ আক্রান্ত হই আমি। সব কিছুই চলছে জীবনের নিয়মে। কিন্তু তারপরও মনে হয় এই চলার কোনো অর্থ নেই। এই চলার কোনো শেষ নেই। শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে থামবে এই চলা! যে রাতে আকস্মাৎ মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনলাম সে মুহূর্তটার কথা কখনও ভোলার মতো না। মায়ের মৃত্যু আমাকে শূন্য করে দিয়েছে। আচমকা সে রাতে চোখের সামনে নির্ভুল কুয়াশা দেখতে পেলাম। ঘন সাদা কুয়াশা। দুটো সরু রেল লাইন সেই কুয়াশায় উধাও হয়ে গেছে। আবছায়া একটা সিগন্যাল পোস্ট। ঝিক করে সিগন্যাল ডাউন হল। কুয়াশার ভিতরে কিছু দেখা যায় না। শুধু একটা রেলগাড়ি এগিয়ে আসার শব্দ পাওয়া যায়। ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক। শরীরে একটা কাঁপুুনি উঠে আসছে। কাঁপন ছড়িয়ে যাচ্ছে সর্বাঙ্গে। শ্রবণ ক্ষীণ হয়ে এলো। ঝিক ঝিক ট্রেনের শব্দের সঙ্গে এক তালে। আমার স্ত্রী আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে। তারপরও সমস্ত শরীর হাড়কাঠে ফেলা বলির পাঁঠার মতো নির্জীব আত্মসমর্পনের দিকে ঢলে পড়ছে। চোখের সামনে কুয়াশা আর কুয়াশা। একটা রেলগাড়ির ঝন ঝন শব্দ। তারপর সব মুছে যাওয়া।
এরপর প্রায় রাতেই মা আসে। কখনও স্বপ্নে। কখনও অবচেতনে। খাটের ওপর পড়ে থাকা মায়ের স্মৃতি ভেসে ওঠে। মায়ের শরীরে মাংস দেখা যায় না। হাড় ক’খানা অবশিষ্ট আছে। মুখটা হা করা, চিৎ হয়ে ঘুমিয়ে আছে। নির্জীব হয়ে। মাঝে মাঝে মনে হয় মা ঘুমোচ্ছেন। খুব রোগা একটা মানুষ। অথচ কিছুদিন আগেও মা সব পারত। বুড়ো হয়ে গেলে মানুষ কতটা অসহায় হয়ে যায় তা মাকে দেখে আমার মনে হয়েছে। আজকাল সব সময় মনে হয় মার জন্য আরো অনেক কিছূ করার ছিল। অনেক কিছু করা যেতো মার জন্য। যখন একা থাকি তখন নানা ভাবনা মাথার মধ্যে গিজ গিজ করতে থাকে। মনে মনে বলি, মা আপনি জানেন না আপনাকে আমি কত ভালবাসি। আমি কতখানি একা হয়ে গেছি। আপনি ছাড়া আমার কেউ ছিল না। আপনি চলে যাওয়ায় পর আমার ভরসার জায়গাটা নষ্ট হয়ে গেছে।
একবার একজন আমাকে বলেছিল, ’যুগটা হচ্ছে ভাগের যুগ। মা কারও কাছে বোঝা, কারও কাছে মাথার মনি। আজকাল মা—বাপকে ছেলেমেয়েরা তেমন ভালবাসতে পারে না। ফলে কাউকেই পারে না। এটা হল একটা পিকিউলিয়ার লাভলেসনেসের যুগ। আজকাল মা—বাপ মরলেও সন্তানরা তেমন কাঁদে না। সেন্টিমেন্টটা যেন কমে গেছে।’ আমার মা যখন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল তখন মনে হয়েছিল, মায়ের আর বেঁচে থাকার দরকার কী? ওরকম মনে হওয়ার কারণ, মা বড্ড কষ্ট পাচ্ছিল। শরীরে, মনে। মায়ের সেই কষ্ট মেনে নিতে পারছিলাম না।
সব সংসারই একটা অন্যটার কার্বন কপি। কোনও সংসারই তেমন পিসফুল নয়। আন্ডারকারেন্ট, পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ, ঘেন্না, জেলাসি। পরিবার থেকে ওটা ধীরে ধীরে সমাজেও সংক্রমিত হয়ে যায়। গল্পটা মোটামুটি একই রকমের। সব মা এখন ভাগের মা। এখন দেশও ভাগের মা, পৃথিবীও ভাগের মা। লোকে কত ভালবাসার কথা বলে, কিন্তু ভালবাসা কাকে বলে তা তার জানা নেই। প্রেমিক প্রেমিকারা কত ভালবাসার কথাটথা বলে ঘর বাঁধে, তারপর তাদের ঝগড়ার জ্বালায় বাড়িতে কাকপক্ষী বসতে পারে না। ভালবাসার গভীরতায় যেতেই পারেনা তারা।
ছোটবেলার স্মৃতিগুলো এখন হানা দেয়। মামা বাড়ি যেতাম মায়ের সাথে। কখনও ভরা বর্ষায়, কখনও শীতের সময়। আমি সবার ছোট ছিলাম বলে মায়ের সাথে সাথে থাকতাম। অথচ সেই আমি ক্রমেই মায়ের কাছে থেকে দূরের হয়ে গেলাম। উনিশ বছর বয়স থেকেই। বরিশাল থেকে একদিন ঢাকায় পাড়ি জমালাম পড়তে। আর সেভাবে ফেরা হলোনা। তারপর আরো বহু দূর। যেখান থেকে ইচ্ছে করলেও যখন তখন মায়ের পাশে গিয়ে বসতে পারিনি। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে আমি ছাড়া আর কেউই মায়ের কাছ থেকে এত দূরে থাকেনি।
এক বৃষ্টি মুখর দিন। আমি ঠায় বসে আছি। আমার কোথাও যাওয়ার নেই। কোনও স্টেশনেই নামবার নেই। বৃষ্টিভেজা দিনে ভাঙাচোড়া মনে সম্পর্কহীন একা। বড় আনমনা। বাইরের দিকে চেয়ে পৃথিবীর সঙ্গে আমার ও মানুষের সম্পর্কের বুননটা আবিষ্কারের চেষ্টা করি। পারি না। আমার চারদিকে একটা গুটিপোকার খোলস আছে। প্রকৃত আমি বাস করি সেই খোলের মধ্যে। সেখানে শক্ত হয়ে থাকি। বাইরের কারও সঙ্গেই আমার সম্পর্ক রচিত হতে চায় না সহজে। এমনকি ভাই বোন স্ত্রী সন্তানদের সাথেও না। কাউকেই আমি ভাল চিনি না। এর কারণ অন্য কিছু নয়, বাক্য। অভাব ভাব প্রকাশের। আমার অতি আপনজনরাও যখন আমাকে বাক্যবাণে জর্জরিত করে বা ছিঁড়ে খুরে ফেলে, আমি কিছু করতে পারি না। কিন্তু মা আমাকে বুঝত। খুব বুঝত।
আমি নিজেকে এক জায়গায় জড়ো করতে পারিনি। এখানে ওখানে টুকরো—টাকরা পড়ে আছে। অনেকটাই পড়ে আছে এক অজ গ্রামে। যেখানে আমি মায়ের সাথে থেকেছি। টিনের ঘর, দারিদ্রের ক্লিষ্ট ছাপ, প্রতি পদক্ষেপে এক পয়সা দু’পয়সার হিসাব। তবু সেখানে আমার অনেকটা পড়ে আছে। আজ এই চকচকে শহর, উন্নত বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সভ্যতার দেশে থেকেও মনে হয় ঢাপরকাঠির সেই অজ পাড়াগাঁ আমার সঙ্গেই আছে। কাদা মাখা পা, উড়ো খুরো চুল, চোখে স্বপ্ন, বিস্ময়ের পর বিস্ময়।
মনে আছে তখন ছাতা ছিল না। কচুপাতা বা টোকা আটকাতে পারত না বৃষ্টিকে। ভেজা গায়ে ঘুরে বেড়াতাম। সারাদিন ভেজা জামা প্যান্ট গায়েই শুকাতো। সর্দি লাগতো না। শরীর সব সয়ে নিত। এক জোড়া সস্তা জুতো ছিল, শীত গ্রীষ্মে পরা হতো। না হলে খালি পায়ে হাঁটতে হতো। তবু সেই সব দিনের স্মৃতি কেন কেবলই আনন্দের শিহরণ বয়ে আনে!
টরন্টো, কানাডা
ঔধংরস.সধষষরশ@মসধরষ.পড়স