অভিবাসের বাংলা নাটকের বটবৃক্ষ || ড. মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম নিউইয়র্ক
স্বাধীন বাংলাদেশে মঞ্চনাটকের যে জোয়ার এসেছিল, যা শুধু নাটকই নয় শিল্পমাধ্যমের সকল শাখাকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল, সেই জোয়ারের অন্যতম পথিকৃৎ রেখা আহমেদ। শীর্ষস্থানীয় নাট্যদল ‘থিয়েটার’—এর একজন বলিষ্ঠ নাট্যজন রেখা আহমেদ মঞ্চের পাশাপাশি অভিনয়ের অন্যান্য প্রায় সকল মাধ্যমেই দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। তিনি যেমন একজন জনপ্রিয় তারকা শিল্পী তেমনি নাট্যকলায় তাঁর ব্যুৎপত্তি অতুলনীয়।
অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী নাট্যজন রেখা আহমেদ। নাটকের বাইরেও তাঁর মেধা, দক্ষতা, সমাজসচেতনতা, ও পরোপকারী স্বভাব আমাদের বিস্মিত করে। তিনি যেমন সহজেই সবার সঙ্গে মিশে যেতে পারেন তেমনি তাঁর জ্ঞান ও ব্যক্তিত্ব দিয়ে অনেকের মাঝেও অদ্বিতীয় হয়ে উঠতে পারেন। নাটক ও নাটকের বাইরে বিভিন্ন আলোচনা ও কর্মকান্ডে তাঁর বক্তব্য কিংবা সিদ্ধান্ত দেখেছি কিভাবে আমাদের জন্য অনুসরণীয় হয়ে ওঠে। এ যেন তাঁর আজন্ম লালিত রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন, সকলের জন্য সম্মান ও অধিকার রক্ষায় তিনি তাঁর সর্বশক্তি দিয়ে লড়বেন। তাঁর এই সংগ্রামের অস্ত্র হচ্ছে তাঁর নাটক। সংলাপ, পোশাক, রূপসজ্জা, মঞ্চ, আলো, শব্দ ইত্যাদি তিনি ব্যবহার করেন অত্যন্ত দক্ষতায় সমাজের যে কোন অনিয়ম ও অসঙ্গতিকে আঘাত করতে।
বাংলাদেশে নাট্যচর্চা ও অর্জনের শিখরে থাকা অবস্থান ছেড়ে তিনি নিউইয়র্কে অভিবাসী হন। তাঁর মানের নাট্যচর্চা, মঞ্চ, নাট্যদল, নাট্যবোদ্ধা — কোন কিছুই এখানে ছিল না, এখনো তৈরি হয়নি। তাঁর সমসাময়িক অনেক প্রথিতযশা নাট্যজন যখন নাটক থেকে স্বেচ্ছায় নির্বাসন নিয়েছেন, তিনি পূর্ণোদ্যমে অভিবাসের নাটকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। যুক্ত হলেন নাট্যদল ঢাকা ড্রামার সঙ্গে। সুযোগ—সুবিধা যেটুকুই আছে, তার ব্যবহারে নিজের অভিনয় দক্ষতা দিয়ে নিউইয়র্কের মঞ্চও কাঁপিয়ে তুলেছেন রেখা আহমেদ। ঢাকা ড্রামার যত নাট্যপ্রযোজনা হয়েছে তার প্রায় সবকটিতে তিনি নানা রূপে ও ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫—এ অনুষ্ঠিত শিল্পাঙ্গন নাট্যমেলায়ও ঢাকা ড্রামার অন্তর্ভুক্ত হয়ে তিনি মঞ্চে তাঁর বলিষ্ঠ অভিনয় দিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন।
নিউইয়র্কের প্রায় সব নাট্যপ্রয়াসে রেখা আহমেদ কোনো না কোনো ভাবে জড়িত থাকেন। কখনো পরামর্শ দিয়ে, কখনো উদ্বোধন করে, আবার কখনো সাধারণ দর্শক হিসেবে উপস্থিত থেকেও তিনি সকল নাট্যকর্মীদের উৎসাহ দেন, শুদ্ধ ও পেশাদার নাট্যচর্চায় উজ্জীবিত করেন। তিনি প্রায় সকল নাট্যকর্মীকেই ব্যক্তিগতভাবে চেনেন, নাম ও পরিচয় মনে রাখেন, দেখা হলেই কুশল জিজ্ঞেস করেন। কেউ নতুন কোনো নাটকের উদ্যোগ নিতে শুনলে খুব আনন্দিত হন, উৎসাহ দেন, এবং নাটকটি মঞ্চে দেখার অপেক্ষায় থাকেন।
আমার সৌভাগ্য হয়েছে কিংবদন্তি নাট্যজন রেখা আহমেদের আশীর্বাদে ধন্য হবার। ২০১৪ থেকে ঢাকা ড্রামার আয়োজনে বিশ্ব নাট্যদিবসে অংশগ্রহণ করে আসছি। তখন থেকে ধীরে ধীরে তাঁর সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং পরামর্শ ও উপদেশ পাবার সৌভাগ্য হয়েছে। ২০১৮—এ অনুষ্ঠিত শিল্পাঙ্গনের প্রথম নাট্যমেলায় তিনি বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এরপর কখনো উদ্বোধক হিসেবে, কখনো অতিথি হিসেবে, কখনো অভিনেতা হিসেবে শিল্পাঙ্গনের সকল নাট্যমেলা ও নাট্যপ্রদর্শনীতে তিনি শারীরিক বা যাতায়াতের সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করেই অংশ নিয়েছেন। পাশাপাশি নাটক নির্বাচন, চরিত্র নির্মাণ, নাটকের মঞ্চায়ন ইত্যাদি বিষয়ে তিনি সরাসরি আলোচনা করেছেন, উপদেশ দিয়েছেন। আমার মত প্রায় সকল নাট্যকর্মীর যে কোন নাট্যপ্রয়োজনে পাশে রয়েছেন রেখা আহমেদ। আর রয়েছে তাঁর সুদীর্ঘ জীবনের নাট্যজ্ঞান ও অভিজ্ঞতা যা তিনি উজাড় করে দেন সকলের জন্য।
নিউইয়র্কে বাংলা নাট্যের চর্চা খুব ধীরে হলেও সমৃদ্ধতর হচ্ছে, সংখ্যায় ও মানে উন্নততর হচ্ছে। অভিবাসের এই নাট্যচর্চার অগ্রযাত্রার পেছনে একজন আলোকিত মানুষ রয়েছেন, একজন অভিভাবক রয়েছেন, একজন পথপ্রদর্শক রয়েছেন। আমাদের সেই বটবৃক্ষের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।